গায়ত্রী দেবী কে ? তার প্রকৃত স্বরূপ কি ?
শিবমহাপুরাণে বলা হয়েছে,
ইয়ং ভগবতী সাক্ষাৎ শঙ্করার্দ্ধশরীরিণী।
পঞ্চবক্ত্রা দশভুজা ত্রিপঞ্চনয়নোজ্জ্বলা ॥ ৫২
নবরত্নকিরীটোদ্যচ্চন্দ্রলেখাবতংসিনী।
শুদ্ধস্ফটিকসঙ্কাশা দশায়ুধধরা শুভা ॥ ৫৩
হারকেয়ূরকটককিঙ্কিণীনূপুরাদিভিঃ।
ভূষিতাবয়বা দিব্যবসনা রত্নভূষণা ॥ ৫৪
বিষ্ণুনা বিধিনা দেবঋষিগন্ধর্বদানবৈঃ ।
মানবৈশ্চ সদা সেব্যা সর্বাত্মব্যাপিনী শিবা ॥ ৫৫
সদাশিবস্য দেবস্য ধর্মপত্নী মনোহরা ।
জগদম্বা ত্রিজননী ত্রিগুণা নির্গুণাপ্যজা ॥ ৫৬
ইত্যেবং সংবিচার্যাথ গায়ত্রীং প্রজপেৎসুধীঃ ।
আদিদেবীং চ ত্রিপদাং ব্রাহ্মণত্বাদিদামজাম্ ॥ ৫৭
যো হ্যন্যথা জপেৎ পাপো গায়ত্রীং শিবরূপিণীম্ ।
স পচ্যতে মহাঘোরে নরকে কল্পসংখ্যয়া ॥ ৫৮
সা ব্যাহৃতিভ্যঃ সংজাতা তাস্বেব বিলয়ং গতা ।
তাশ্চ প্রণবসম্ভূতা প্রণবে বিলয়ং গতাঃ ॥ ৫৯
প্রণবঃ সর্ববেদাদিঃ প্রণবঃ শিববাচকঃ ।
মন্ত্রাধিরাজারাজশ্চ মহাবীজং মনুঃ পরঃ ॥ ৬০
শিবো বা প্রণবো হ্যেষ প্রণবো বা শিবঃ স্মৃতঃ ।
বাচ্যবাচকয়োর্ভেদো নাত্যন্তং বিদ্যতে যতঃ ॥ ৬১
এনমেব মহামন্ত্রং জীবানাং চ তনুত্যজাম্ ।
কাশ্যাং সংশ্রাব্য মরণে দত্তে মুক্তিং পরাং শিবঃ ॥ ৬২
তস্মাদেকাক্ষরং দেবং শিবং পরমকারণম্।
উপাসতে যতিশ্রেষ্ঠা হৃদয়াম্ভোজমধ্যগম্ ॥ ৬৩
মুমুক্ষবোঽপরে ধীরা বিরক্তা লৌকিকা নারাঃ ।
বিষয়ান্মনসা জ্ঞাত্বোপাসতে পরমং শিবম্ ॥ ৬৪
[তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/কৈলাস সংহিতা/১৩ অধ্যায়/ শ্লোক]
🌷 অর্থ — (এইভাবে গায়ত্রীর ধ্যান করবে, যেভাবে গায়ত্রীর স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে) ভগবতী গায়ত্রী সাক্ষাৎ ভগবান শংকরের অর্ধদেহে বাসকারিণী। এঁর পাঁচ মুখ এবং দশটি হস্ত, পনেরোটি চক্ষু দ্বারা তিনি প্রকাশিত হন। নতুন রত্নময় কিরীটে চমকিত চন্দ্ররেখা তাঁর মস্তক অলংকৃত করে। তাঁর অঙ্গকান্তি শুদ্ধ স্ফটিক মণির মতো উজ্জ্বল। এই সুলক্ষণা দেবী তাঁর দশ হাতে দশপ্রকার অস্ত্রধারণ করেন। হার, কেয়ূর (বাজুবন্দ), বালা, চেতন, নূপুর ইত্যাদি দ্বারা তাঁর দেহ অলংকৃত। তিনি দিব্যবস্ত্র পরিধান করে আছেন। তাঁর সকল অলংকারই রত্ননির্মিত ॥ ৫২-৫৪
বিষ্ণু, ব্রহ্মা, দেবতা, ঋষি, গন্ধর্বরাজ এবং মানুষও সর্বদা এঁর সেবা করেন। এই সর্বব্যাপিনী শিবা সদাশিবদেবের মনোহারিণী ধর্মপত্নী, সম্পূর্ণ জগতের মাতা, ত্রিলোকের জননী, ত্রিগুণময়ী, নির্গুণা এবং জন্মরহিতা ॥ ৫৫-৫৬
এই প্রকারের গায়ত্রীর স্বরূপ চিন্তা করে জ্ঞানী (বুদ্ধিমান) ব্যক্তির উচিত গায়ত্রী মন্ত্রের জপ করা; কারণ, গায়ত্রী হলেন আদিদেবী, ত্রিপদা (তিনস্তর বিশিষ্ট), তিনি ব্রাহ্মণত্ব ইত্যাদি প্রদানকারী এবং অজন্মা (শিবের শক্তি)। কিন্তু যে পাপী ব্যক্তি শাস্ত্রবিধিকে উলঙ্ঘন করে শিবরূপিণী গায়ত্রী মন্ত্রের জপ করে, সে দীর্ঘকাল কল্পকাল ধরে নরকে গিয়ে কঠিন যন্ত্রণা ভোগ করে ॥ ৫৭-৫৮
ব্যাহৃতিসমূহ থেকেই গায়ত্রী উৎপন্ন হয়ে তাতেই লীন হয়ে যান। প্রণব (ॐ) থেকে বাহৃতি প্রকটিত হয়ে প্রণবেই লয় প্রাপ্ত হন ॥ ৫৯
প্রণবই সম্পূর্ণ বেদের আদি, এটি শিবের বাচক, মন্ত্রসমূহের রাজাধিরাজ, মহাবীজস্বরূপ এবং শ্রেষ্ঠ মন্ত্র ॥ ৬০
শিব প্রণব এবং প্রণবকে শিব বলা হয়। কারণ, উচ্চারিত নাম (বাচক) ও যার নাম উচ্চারিত হয় (বাচ্য) - এই দুটির মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনও ভেদ নেই ॥ ৬১
কাশীতে জীবের মৃত্যুর সময়, শিব নিজে এই (প্রণব) মন্ত্র শোনান প্রাণত্যাগে রত জীবকে এবং এর দ্বারা তিনি তাদের মুক্তি প্রদান করেন। এই কারণেই, এই একাক্ষরবিশিষ্ট, দিব্য, মঙ্গলময় ও পরম কারণরূপী এই মন্ত্রকে — যতিশ্রেষ্ঠ(মহান সন্ন্যাসী) যোগীদের নিজের হৃদয়পদ্মের মধ্যে উপাসনা করে থাকেন ॥ ৬২-৬৩
এছাড়াও, অন্যান্য মুক্তিকামী (মুমুক্ষু), ধৈর্যশীল, বৈরাগ্য-সম্পন্ন ও সাধারণ সংসারী ব্যক্তিগণও এই বিষয়গুলিকে ভালভাবে জেনে, পরম শিবেরই উপাসনা প্রণব (ॐ-কার) -এর মাধ্যমে করে থাকেন ॥ ৬৪
🔷 বিশ্লেষণ : লক্ষ্য করুন, এখানে গায়ত্রী দেবীকে সদাশিবের পত্নী “শিবা” বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ব্রহ্ম হলেন শিব, আর ব্রহ্মের ব্রহ্মবিদ্যাকে শক্তি বলা হয়, তাই শিবের পরাশক্তি দেবী দুর্গাকে “শিবা” বলা হয়।
পরমেশ্বর সদাশিব হলেন ত্রিদেব (ব্রহ্মা,বিষ্ণু ও রুদ্র) -এর উৎপত্তিকর্তা, পাঁচ মুখ ও দশহাত সম্পন্ন, তিনি শিবলোকে স্থিত।
গায়ত্রী দেবী হলেন সেই পরমেশ্বর শঙ্করের দেহের অর্ধশরীর - এই বচনের দ্বারা সরাসরি দেবী শিবা কে নিশ্চিত করে দেওয়া হয়েছে,
আবার এদিকে পঞ্চমুখসম্পন্ন শিবের ন্যায় গায়ত্রী দেবীকেও পাঁচমুখবিশিষ্টা বলা হয়েছে, একথা কৃষ্ণ- যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যেকের ১০ম প্রপাঠকের ৩৫তম অনুবাকে “শ্বেতবর্ণা সাংখ্যায়নসগোত্রা গায়ত্রী চতুর্বিংশত্যক্ষরা ত্রিপদা ষটকুক্ষিঃ পঞ্চশীর্ষোপনয়নে বিনিয়োগঃ ॥” উল্লেখ আছে , এরই সাথে মহানারায়ণ উপনিষদের ৩৫ অনুবাকে এই মন্ত্রটিই হুবহু উল্লেখ আছে।
দেবী গায়ত্রীকে শিবরূপিণী বলা হয়েছে, অর্থাৎ শিবেরই রূপ হলেন গায়ত্রী। এই গায়ত্রী দেবীকে ব্রহ্মবিদ্যা অর্থাৎ শিবের বিদ্যা বলা হয়েছে। এই দেবীর গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে শিবকে লাভের বিদ্যা অর্জন করে তবেই শিবলাভ সম্ভব হয়, তাই ব্রহ্মবিদ্যা আদিশক্তি শিবার এই গায়ত্রী মন্ত্রের জপ করা হয়, যা সমগ্র বেদের তথা সনাতন ধর্মের সকল শাস্ত্রের আদেশ বলে সর্বজন বিদিত।
এমনকি এই গায়ত্রীর সেবা স্বয়ং বিষ্ণু, ব্রহ্মা, ঋষি, মুনি আদি সকলেই করেন। অর্থাৎ সকলেই শিবকৃপা লাভের জন্য গায়ত্রী দেবীর সেবা করেন।
অর্থাৎ, গায়ত্রী দেবী হলেন — শিবপত্নী ‘শিবা’। আমরা শৈবরা তাকে দুর্গা, মহাকালী, ত্রিপুরাসুন্দরী বলে থাকি।
এই গায়ত্রী মাতা দুর্গার গায়ত্রী মন্ত্রের উৎপত্তি হয়েছে ব্যহৃতি তথা প্রণব থেকে, প্রণব বলতে ॐ-কার কে বলে। এই ॐ কার শিবেরই অর্থ কে নির্দেশ করে, এটি শিবেরই বীজমন্ত্র।
________________
🌺 গায়ত্রী মন্ত্র 🌺
ॐ ভূ র্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ ॥
[তথ্যসূত্র : ঋগবেদ/শাকল শাখা/৩য় মণ্ডল/৬২ সূক্ত/১০ নং মন্ত্র, শুক্ল-যজুর্বেদ/৩য় অধ্যায়/৩৫ নং মন্ত্র,শুক্ল-যজুর্বেদ/৩০ অধ্যায়/২নং মন্ত্র, সামবেদ উত্তরার্চ্চিক/৬/৩/১০নং মন্ত্র]