5 শক্তিশালী নাগ
পাঁচটি বিশেষ ও শক্তিশালী নাগের বর্ণনা পাওয়া যায়। যাঁরা বিভিন্ন কারণে বিশেষ।
এই পাঁচ নাগ হলেন শেষনাগ, বাসুকী, তক্ষক, কর্কটক, কালিয়া।
নাগদেরও দেবতা রূপে পুজো করার প্রথা প্রচলিত রয়েছে। শাস্ত্রে এমন বহু নাগ দেবতাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন শিবের গলায় জড়িয়ে থাকা বাসুকী, বিষ্ণুর শেষনাগ। তবে শুধু এই দুই নাগই নয়, পুরাণে এমন পাঁচটি নাগের উল্লেখ পাওয়া যায়, যারা দেবতাদের প্রিয়। আবার তাদেরও দেবতা রূপে পুজো করা হয়। হিন্দু ধর্মে উল্লিখিত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সর্প বা নাগ সম্পর্কে এখানে জানানো হল।
1. শেষ নাগ
শেষনাগ হিন্দু পুরাণের এক মহাশক্তিশালী ও মহাপবিত্র নাগরাজ, যিনি কশ্যপ মুনি ও কদ্রুর পুত্র এবং বাসুকী, তক্ষক প্রমুখের ভাই। তাঁকে "অনন্ত" নামেও ডাকা হয়, যার অর্থ—অসীম বা যার কোনো শেষ নেই। শেষনাগ বহু মাথা বিশিষ্ট এক বিশাল সাপ, যিনি অনন্ত জলরাশির ওপর কুণ্ডলিত অবস্থায় শ্রীবিষ্ণুকে শয্যা দেন। তিনি শুধু বিষ্ণুর বাহক নন, বরং সমগ্র পৃথিবীকে তাঁর কুণ্ডলীতে ধারণ করে রাখেন বলেও বিশ্বাস করা হয়। প্রলয়ের সময় যখন সবকিছু বিলীন হয়ে যায়, তখন বিষ্ণু শেষনাগের ওপর শয়ন করে বিশ্ব রক্ষার প্রতীক্ষায় থাকেন। বলরাম, শ্রীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, শেষনাগেরই এক মানব অবতার বলে বিবেচিত। শেষনাগ শক্তি, ধৈর্য, নিষ্ঠা ও ভক্তির এক চিরন্তন প্রতীক।
বাসুকী নাগ হিন্দু পুরাণের এক বিশাল ও শক্তিশালী নাগরাজ, যিনি কশ্যপ মুনি ও কদ্রুর পুত্র এবং শেষনাগ, তক্ষক প্রমুখের ভাই। তিনি বহু ফণা বিশিষ্ট এক বিষধর সর্প, যিনি সমুদ্র মন্থনের সময়ে মন্দার পর্বতকে ঘিরে দড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলেন। বাসুকী দেবতা ও অসুরদের মধ্যে এই মন্থনের সময়ে তাঁর ফণা থেকে যে ভয়ঙ্কর বিষ নির্গত হয়েছিল, তা বিশ্ব ধ্বংসের হুমকি সৃষ্টি করেছিল; তখন সেই বিষ ধারণ করেন ভগবান শিব, যিনি তখন থেকে "নীলকণ্ঠ" নামে পরিচিত হন। বাসুকী ছিলেন শিবের পরম ভক্ত এবং অনেক পৌরাণিক চিত্রে দেখা যায় তিনি শিবের গলায় পেঁচানো আছেন। ভক্তি, শক্তি ও বিষধর রূপের সমন্বয়ে বাসুকী হিন্দু পুরাণে এক গুরুত্বপূর্ণ, গৌরবময় নাগসত্তা।
তক্ষক নাগ হিন্দু পুরাণের অন্যতম বিখ্যাত ও প্রভাবশালী নাগরাজ, যিনি ছিলেন কশ্যপ মুনি ও কদ্রুর পুত্র এবং বাসুকী, শেষনাগ, কর্কট প্রমুখের ভাই। তক্ষক নাগের পরিচিতি সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় মহাভারতের পরবর্তী অংশে, বিশেষ করে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ ও অস্তীক উপাখ্যান-এ।তক্ষক ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী, বিষধর ও প্রতিশোধপরায়ণ। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাহিনি হল রাজা পারীক্ষিতকে দংশন করার ঘটনা। একবার পারীক্ষিত এক ঋষিকে তুচ্ছজ্ঞান করে অপমান করেছিলেন, ফলে ঋষিপুত্র শ্রঙ্গি অভিশাপ দেন যে সপ্তম দিনে তাঁকে এক বিষধর সাপ দংশন করে মারবে। সেই অভিশাপ অনুযায়ী তক্ষক সপ্তম দিনে পারীক্ষিতকে দংশন করেন এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এরপর পারীক্ষিতের পুত্র জনমেজয় পিতার প্রতিশোধ নিতে বিশাল সর্পসত্র যজ্ঞ আয়োজন করেন। এই যজ্ঞে পৃথিবীর সব সাপ আহ্বান করা হয় ও আগুনে পতিত হতে থাকে। তক্ষক ব্রঋষি কশ্যপের আশ্রয়ে নিজেকে রক্ষা করলেও, যজ্ঞ এতই শক্তিশালী ছিল যে কশ্যপের মন্ত্রও ব্যর্থ হয়(মতান্তরে ইন্দ্রের কাছে)। শেষে ঋষি আস্তীক তাঁর বুদ্ধি ও বাগ্মিতা দিয়ে যজ্ঞ বন্ধ করেন এবং তক্ষকসহ অন্যান্য সাপদের প্রাণ বাঁচান।
তক্ষক নাগ কেবল একটি বিষধর সাপ নন, তিনি একদিকে প্রতিশোধ, ভয় ও বিষের প্রতীক, আবার অন্যদিকে মহাশক্তির অধিকারী এক দেবত্বপূর্ণ সত্তা, যিনি ধর্ম ও অধর্মের দ্বন্দ্বের এক জ্যান্ত উদাহরণ। তাঁর কাহিনি হিন্দু ধর্মে পাপ, শাস্তি, ক্ষমা এবং ভক্তির জটিল সম্পর্ককে গভীরভাবে প্রতিফলিত করে।
কর্কট নাগ হিন্দু পুরাণের একজন বিশিষ্ট ও বুদ্ধিমান নাগ, যিনি কশ্যপ মুনি ও কদ্রুর পুত্র হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মহাভারতের নল-দময়ন্তী কাহিনিতে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যেখানে কর্কট একটি অগ্নিকুণ্ড থেকে উদ্ধার পাওয়ার পর রাজা নলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। নিজের বিষ দ্বারা নলকে দংশন করে তিনি তাঁর চেহারা পরিবর্তন করে দেন, যাতে নল ছদ্মবেশে নিরাপদে থাকতে পারেন এবং পরে আবার তাঁর প্রকৃত রূপ ফিরিয়ে দেন। কর্কট নাগের এই কাহিনি তাকে শুধু একজন সাপরূপে নয়, বরং কৃতজ্ঞ, ধর্মপরায়ণ ও সহায়ক চরিত্র হিসেবেও তুলে ধরে।
কালিয়া নাগ হিন্দু পুরাণের এক ভয়ংকর ও বিষধর সাপ, যিনি যমুনা নদীতে বাস করতেন এবং তার বিষে নদীর জল ও আশপাশের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। কালিয়া ছিল বহু ফণা বিশিষ্ট এক প্রবল শক্তিশালী নাগ, যার বিষাক্ত নিঃশ্বাসে গাছপালা শুকিয়ে যেত এবং পাখিরা মরে যেত। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বাল্যকালে গোকুলে এই কালিয়ার অত্যাচার দেখে যমুনায় ঝাঁপ দেন এবং এক ভয়ংকর লড়াইয়ে কালিয়াকে পরাজিত করেন। কৃষ্ণ কালিয়ার ফণার উপর নৃত্য করে তাকে দমন করেন এবং শেষে তার অহংকার ভেঙে দিলে, কালিয়া ভক্তি সহকারে ক্ষমা চায়। শ্রীকৃষ্ণ তাকে ক্ষমা করে ফিরে যেতে নির্দেশ দেন। এই কাহিনি ভক্তিতে, ন্যায়বোধে এবং কৃষ্ণের মহিমায় এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে।