অর্ধমাত্রা, নাদ ও বিন্দু
"অর্ধমাত্রা" - পদের যথার্থ তথা সর্বোচ্চ ব্যাখ্যা: নাদ, বিন্দু, কলা এবং মনোন্মনী তত্ত্ব বিশ্লেষণ:-
" ত্বং অক্ষরে নিত্যে ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা |
অর্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যানুচ্চার্যা বিশেষতঃ ॥ "
(শ্রীশ্রী দুর্গাসপ্তসতী)
অর্থ: হে দেবী পার্বতী, অক্ষর ব্রহ্ম অর্থাৎ শব্দ ব্রহ্মের আদিমতম রূপ প্রণব ওঙ্কারের তিন মাত্রায় (অ, উ, ম) সাক্ষাৎ আপনি স্থিতা। সেই মহা প্রণবের তিন মাত্রার মহাপ্রকৃতিতে লয় পাবার পরেও যে সূক্ষ্ম, নিত্য, অব্যক্ত, অগম্য এবং অনুচ্চার্য্য অর্ধমাত্রা বিদ্যমান থাকে, তাহাও আপনি।
" অনুচ্চার্যা অর্ধচন্দ্ররোধিন্যাদিধ্বন্যষ্টকরুপা " (গুপ্তবতী টীকা)
✍️বিস্তারিত ব্যাখ্যা -
🍀অর্ধমাত্রা -
সাধারণ দৃষ্টিতে বিন্দু ও নাদ কে একত্রে অর্ধমাত্রা বলা হয়। কিন্তু তন্ত্রের আরো উচ্চ কোটির পর্যায়ে এই অর্ধমাত্রাকে আরো বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। আজ্ঞা চক্রের উপরে বিন্দু থেকে অর্ধচন্দ্র হয়ে নিরোধিকা (রোধিনী), নাদ, নাদান্ত (মহানাদ), শক্তি, ব্যাপিনী (আঞ্জা কলা) ও সমনী (অনাশ্রয়) - মহাপ্রণবের এই আটটি সূক্ষ্ম মাত্রাই অর্ধমাত্রা হিসেবে অভিহিত। অর্ধমাত্রার চেয়ে সূক্ষ্মতর কোনো কিছুর অস্তিত্বই ত্রিভুবনে নেই, যা " অর্ধমাত্রা পরাসূক্ষ্মা " ইত্যাদি আগম বাক্য দ্বারা সিদ্ধ। এই প্রত্যেক অর্ধমাত্রা সাক্ষাৎ সেই উমারই বোধক। অ, উ, ম ক্ষরণশীল, ইহা ক্ষর কিন্তু অর্ধমাত্রা অক্ষর, নিত্য, যার কোনো ক্ষরণ নেই। এই অর্ধমাত্রা এর ভেদন যোগীগণের নিকটও সরল নয়। তন্ত্রান্তরে আজ্ঞা চক্রের উপরে স্থিত এই অর্ধমাত্রা সমূহের নাম হল যথাক্রমে - বিন্দু, কলাপদ , নিবোধিকা, অর্ধচন্দ্র, নাদ, নাদান্ত, উন্মনী, বিষ্ণুবক্ত্র, ধ্রুবমণ্ডল ও শিব। এই দশটি মাত্রা এবং মূলাধারাদি ছয়টি চক্র মিলে হয় - ষোড়শাধার। তাছাড়া তন্ত্রান্তরে দ্বাদশাধার এরও উল্লেখ পাওয়া যায় - ব্যোম, অগ্নি, বামলোচনা, বিন্দু, অর্ধচন্দ্র, নিরোধিকা (রোধিনী), নাদ, নাদান্ত (মহানাদ), শক্তি, ব্যাপিনী, সমনী (অনাশ্রয়) ও উন্মনী।
[হ্রস্ব স্বরের উচ্চারণ কালকেই সাধারণত মাত্রা বলা হয়।
১ মাত্রা = ২৫৬ লব। সুতরাং, মাত্রার ১/২৫৬ অংশকে লব বলা হয়। সমনীর উচ্চারণকাল ১ লব বা মাত্রার ১/২৫৬ অংশ।]
🍀বিন্দু তত্ত্ব / ইন্দু / পূর্ণচন্দ্র -
দ্বৈত শৈবতন্ত্রে এবং অদ্বৈত শৈব ও শাক্ত তন্ত্রে বিন্দুর ধারণার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ করা যায়। বিসর্গের দ্বিতীয় বিন্দুই এই অর্ধমাত্রার প্রথম স্তর বিন্দু হিসেবে অভিহিত, তন্ত্রান্তরে ইহারই নাম কৈলাস শিব। এই বিন্দু ললাট ভাগে, আজ্ঞা চক্রের উপরে অবস্থিত। এই বিন্দু দীপকের / প্রদীপের ন্যায় উজ্জ্বল ও গোলাকৃতি - " দীপাকারো অর্ধমাত্রশ্চ ললাটে বৃত্ত ঈষ্যতে " | হ্রস্ব স্বরের উচ্চারণ কালকেই মাত্রা শব্দে অভিহিত করা হয়। আর এই বিন্দুর উচ্চারণকাল উহার অর্ধেক (১/২ মাত্রাংশ), সুতরাং বিন্দুই প্রাথমিক অর্ধমাত্রা। এই বিন্দু কোটি সূর্য প্রভার সমতুল্য। এই বিন্দুর মধ্যে দশ কোটি যোজন বিস্তর পদ্ম বিদ্যমান । এই পদ্মের কর্ণিকায় ভগবান শান্ত্যতীতেশ্বর শিব বিরাজমান, যার পাঁচ মুখ, দশবাহু, যার বাম ভাগে অবস্থিতা শক্তি হলেন - শান্ত্যাতীতা, যিনি বাক্য ও মনের অগোচর, চারপাশে বেষ্টন করে রয়েছে বাকি চার কলা নিবৃত্তি, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা ও শান্তি কলা। ইহারা প্রত্যেকেই পঞ্চমুখ ও দশভুজ বিশিষ্ট, মাথায় প্রত্যেকের শোভা পায় চন্দ্রকলা। এই বিন্দুই পূর্ণচন্দ্র প্রতীকে বোধিত হয়। আজ্ঞাচক্রের পর বিন্দুস্থানই যোগী ও জ্ঞানী-সাধকের তৃতীয়- চক্ষু বা জ্ঞানচক্ষু, যে তৃতীয় নয়ন বা জ্ঞানচক্ষু আমরা লক্ষ্য করি দেব বা দেবীদের (কপালের) মধ্যে। নাদের সংঘট্ট রূপই হল বিন্দু।
[প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, বিসর্গের প্রথম বিন্দুর অবস্থান সহস্রারের ঊর্ধ্বদেশে। ]
🍀অর্ধচন্দ্র -
বিন্দুর পর আসে অর্ধচন্দ্র বা অর্ধেন্দু। বিন্দু অর্থাৎ পূর্ণচন্দ্রের অর্ধেক ভাগ দ্বারাই ইহা নির্মিত তাই ইহার আকৃতি অর্ধচন্দ্রাকৃতি, ইহাও প্রদীপের ন্যায় উজ্জ্বল। ইহার উচ্চারণকাল মাত্রার ১/৪ অংশ অর্থাৎ বিন্দুর সাপেক্ষে ইহা অর্ধমাত্রা। জোৎস্না, জোৎস্নাবতী, কান্তি, সুপ্রভা ও বিমলা - অর্ধচন্দ্রের এই পাঁচ কলা বিদ্যমান।
🍀রোধিনী/নিরোধিকা/বোধিনী -
তারপর রোধিনী অবস্থায় উচ্চ কোটির আত্মা এসে উপনীত হন। ইহা ব্রহ্মা ইত্যাদি বিভিন্ন দেবতাদেরকে পরমতত্ত্ব মহাবিন্দু পরমশিব এর দিকে অগ্রসর হতে বাধা প্রদান করে জন্যই এই স্তরের নাম নিরোধিকা। ইহা চন্দ্রাতপ অর্থাৎ জোৎস্নার ন্যায় এবং ত্রিকোণ আকৃতির। আবার কেহ কেহ ইহাকে অগ্নিশিখা সদৃশ উপলব্ধি করেন। ইহার উচ্চারণ কাল মাত্রার ১/৮ ভাগ অর্থাৎ অর্ধচন্দ্রের সাপেক্ষে ইহা অর্ধমাত্রা। সম্মোহন তন্ত্র মতে ইহা বোধিনী শব্দে বাচিত হয়েছে। ইহা গান্ধারী রাগ সমন্বিত। এই নিরোধিকার পাঁচটি কলা হল - বন্ধিনী, বোধিনী, বোধা, জ্ঞানবোধা ও তমোপহা। আবার তন্ত্রান্তরে, এই নিরোধিকা বহ্নিকলা রূপে সহস্রার পদ্মে অবস্থিত নির্বাণ কলার নীচে স্থিত।
🍀নাদ -
এই রোধিনী-অবস্থা ভেদ ক'রে সাধক ক্রমশঃ নাদ ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হন। ইহার আকৃতি দুই বিন্দুর মাঝে ঋজু রেখা সদৃশ (শেব আকৃতির)। তন্ত্রান্তরে ইহা অর্ধচন্দ্রাকৃতি এবং পদ্মরাগ মণির ন্যায় কান্তিবান, বর্ণ পদ্মকেশরের ন্যায় এবং কোটি সূর্যের ন্যায় ইহা উজ্জ্বল। তন্ত্রান্তরে এই নাদের দীপ্তি বলরামের ন্যায় শুভ্র ও চন্দ্রামৃতের ন্যায় - " বলধবলসুধাধারসন্তানহাসী " |
সম্মোহন তন্ত্র মতে, " ইন্দুর্ললাটদেশে চ তদূর্ধ্বে বোধিনী স্বযম্ | তদূর্ধ্বে ভাতি নাদোহসাবর্দ্ধচন্দ্রাকৃতি পরঃ " |
এই নাদ পঞ্চকলাময়, ইহারা যথাক্রমে - ইন্ধিকা, দীপিকা, রোচিকা (বৈন্দব), মোচিকা ও ঊর্ধগা। ইহারা চারপাশে অসংখ্য ভুবন দ্বারা পরিব্যাপ্ত। মধ্যভাগে এক অর্বুদ যোজন বিস্তৃত, কোটি চন্দ্রপ্রভার সমতুল্য এক পদ্ম বিদ্যমান, যার কর্ণিকায় অবস্থান করছেন কোটি চন্দ্রের ন্যায় কান্তিবান ত্রিনেত্র, পঞ্চবক্ত্র, ত্রিশূল ও জটাজুটধারী ঊর্ধ্বগামী ভগবান শিব এবং তাঁর ক্রোড়ে বিদ্যমানা রয়েছেন তাঁর শক্তি ঊর্ধ্বগামিনী ভগবতী । নাদের উচ্চারণকাল মাত্রার ১/১৬ অংশ।
" তদূর্ধ্বে চন্দ্রার্ধস্তদুপরি বিলসৎ বিন্দুরুপি মকারস্তদূর্ধ্বে নাদোহসৌ বলধবলসুধাধারসন্তানহাসী " | --- তন্ত্রান্তরে এই নাদের অতিরিক্ত অপর আরো একটি নাদ বিদ্যমান , যার অবস্থান আজ্ঞা চক্রের কুটস্থ বীজ ওঙ্কারের ঊর্ধ্বভাগে। আজ্ঞা চক্রের ত্রিকোণ ভাগে প্রোথিত ইতরাখ্য/শুক্লাখ্য লিঙ্গকে ব্রহ্মসূত্রের ন্যায় পেঁচিয়ে রয়েছে অন্তরাত্মা স্বরূপ প্রণব, যা অকার এবং উকার দ্বারা নির্মিত। ইহার উর্ধ্বভাবে সেই নাদ অবস্থিত, যার আকৃতি অর্ধচন্দ্রের ন্যায়। এই অর্ধচন্দ্রাকৃতি নাদের উর্ধ্বে অবস্থিত বিন্দু, যা প্রকৃতপক্ষে বিন্দুরূপি মকার। এই বিন্দু এবং উপরে বর্ণিত বিন্দুতত্ত্ব অভিন্ন, ইহাই শাস্ত্রের মীমাংসা।
🍀নাদান্ত বা মহানাদ -
" তদূর্ধ্বে চ মহানাদো লাঙ্গলাকৃতিরুজ্জ্বলঃ " |
ইহা বিদ্যুতের ন্যায় দীপ্তিমান, ইহা হলাকৃতি/লাঙ্গলাকৃতি। ইহার অবস্থান ব্রহ্মরন্ধ্রে। ইহার দক্ষিণভাগ বিন্দু সংযুক্ত। ইহার উচ্চারণকাল মাত্রার ১/৩২ অংশ। এই সূক্ষ্ম স্তরে এসে নাদও লয়প্রাপ্ত হয়। তন্ত্রান্তরে ইহাই ঊর্ধ্বগা হিসেবে খ্যাত। আজ্ঞাচক্রের ছবিতে প্রণবের বিন্দুর উর্ধ্বে যে খণ্ডিত অর্ধচন্দ্রের মত প্রতিকৃতি দেখতে পাওয়া যায় উহাই হল - এই নাদান্ত। ব্রহ্মরন্ধ্রে স্থিত নিরালম্বপুরীর ব্রহ্মবিলে প্রস্ফুটিত কমল এর পাঁপড়িই যেন হলাকৃত/খণ্ডিত অর্ধচন্দ্রাকৃত ভাবে কেটে নেমে এসেছে আজ্ঞা চক্রে , সে সেখানে গুরুর আজ্ঞার জন্য অপেক্ষারত, ইহাই সাধকের উপলব্ধি। সাক্ষাৎ ব্রহ্ম শিবস্বরূপ গুরু যখন আজ্ঞা করবেন, তখনই যোগীর আত্মা এসে গাঁথবে সেই হলে, গুরুর আজ্ঞা স্বরূপ সেই হল ধরেই সাধক পৌঁছাবে নিরালম্বপুরীর সেই ব্রহ্মবিলে (১১ কোটি অর্বুদ যোজন বিস্তৃত), সেখানেই স্থিত রয়েছেন ব্রহ্মশিব। তবে সেই পরমব্রহ্ম পরমশিবের সাথে সাধকের সাক্ষাৎকার এখনো বাকি।
🍀শক্তি এবং ব্যাপিনী -
ব্রহ্মবিলের উর্ধ্বে রয়েছে শক্তিধাম। দুটি বিন্দুর মধ্যে বাম দিকের বিন্দুর উপরিভাগ হতে সোজা একটি ঊর্ধ্বগামী রেখা অঙ্কন করলে , তা হবে এই শক্তি তত্ত্বের আকৃতি। এই শক্তিধামই হল সমগ্র ভুবনাধ্ব এর আধার। এর চারদিকে অবস্থান করছে সূক্ষ্মা, সুসূক্ষ্মা, অমৃতা ও মৃতা। এই চার শক্তির মাঝে অবস্থিত ব্যাপিনী/ ব্যাপিকা, যার আকৃতি অধঃমুখ ত্রিভুজের ন্যায় যার নিম্নশীর্ষ বিন্দু সংযুক্ত। এই ব্যাপিনী কে পঞ্চমুখ ও ত্রিনেত্রধারিনী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে আগমে। ব্যাপিনীকেই তন্ত্রান্তরে আঞ্জী কলা নামে বোধিত করা হয়েছে, ইহা যোগীগণের নিকট অত্যন্ত প্রিয়। শক্তির উচ্চারণকাল - মাত্রার ১/৬৪ ভাগ এবং ব্যাপিনীর উচ্চারণকাল মাত্রার ১/১২৮ ভাগ।
🍀সমনী/ সমনা -
ব্যাপিনী শক্তির উর্ধ্বে অবস্থিত সর্ব কারণের কারণ সমনা। কালের অন্তিম পর্যায় হল এই সমনা। ইহার উচ্চারণকাল মাত্রার ১/২৫৬ ভাগ। উপর এবং নীচে স্থিত দুইটি বিন্দুর মাঝে অঙ্কিত ঋজু রেখা - ইহাই সমনার আকৃতি। মায়াণ্ড, প্রকৃত্যণ্ড, শাক্তাণ্ড, ব্রহ্মাণ্ড ইত্যাদির ভরণ পোষণ ইহাই করে। ইহার দ্বারাই পরমেশ্বর শিব পঞ্চকৃত্যসম্পন্ন করে থাকেন। ইহাই কারণ শক্তি। শক্তি হতে সমনা পর্যন্ত স্থানের কান্তি নব উদিত ১২ আদিত্যর ন্যায়।কাল ও মনের অন্তিম সীমা এই সমনী পর্যন্তই, তাই ইহাকেই তন্ত্রান্তরে মনোন্মনী বলা হয়েছে। ইহাকেই আবার তন্ত্রান্তরে অনাশ্রয় বলা হয়েছে, যাহতে অনন্ত, অনাথ, অনাশ্রিত ইত্যাদি তত্ত্ব লয় পায়। আবার কাহারো মতে এই সমনীই হল - কালসংকর্ষণী, মাতৃসদ্ভাবের প্রথম স্পন্দন বা সৃষ্টিকালী (সৃষ্টি চক্রে) অথবা মহাভৈরবঘোরোগ্রচণ্ডকালী (অনাখ্য চক্রে)।
🍀উন্মনা/ উন্মনী -
একটি বিন্দুর উপরে সোজা ঊর্ধ্বমুখী রেখা টেনে দিল যে প্রতিকৃতির সৃষ্টি হয় সেটিই উন্মনীর আকৃতি। ইহার প্রকৃতপক্ষে কোনো আকার নেই বললেই চলে, ইহা মাত্রাতীত, আবার তন্ত্রান্তরে ইহার উচ্চারণকাল মাত্রার ১/৫১২ অংশ। ইহা কালাতীত। মনের লয় এখানে এসে ঘটে জন্য ইহার নাম উন্মনা। ইহাই পরম নির্বাণ স্থান। ইহা নিরাকার। তন্ত্রান্তরে ইহাই অদ্বৈত রুদ্রবক্ত্র বা অদ্বৈত ভৈরবীয় মুখ (অব্যক্ত সপ্তম মুখ) হিসেবে পরিচিত, ইহাই পরমেশ্বরের নির্বিকল্প নিরঞ্জন শক্তি। ইহাই অনাখ্য অবস্থা, ইহাই কালসংকর্ষণী তত্ত্ব, কারণ উন্মনা কালের অতীত, মহাকালেরও অতীত। তন্ত্রান্তরে উন্মনা স্তরকেও মনোন্মনী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
তন্ত্রান্তরে উন্মনীই সেই সপ্তদশী বিমলা কলা/অমাকলা/হার্ধকলা, পরাকুণ্ডলিনী স্বরূপা।
ত্রিক শৈবাচার্য শ্রী অভিনবগুপ্ত তাঁর 'পরাত্রিংশিকা বিবরণ' এ' ব্যাখ্যা করছেন -
"অমতীতি অমা, অ-মা-ইতি, অবিদ্যমানং মা-মানং, নিষেধঃ নিত্যোদিব্যাৎ সংহারশ্চ যত্র সা ভগবতী অমা ইতি উত্যতে | হৃদয়স্থা তু যা শক্তি কৌলিকী কুলনায়িকা...."
অর্থাৎ অমাকলাই (ঊর্ধ্বকুণ্ডলিনী সপ্তদশীকলা) সাক্ষাৎ ভগবতী পরাশক্তির বাচক। হৃদয়াস্থিতা (পরমেশ্বরের) সেই শক্তিই কৌলিকী, কুলনায়িকা নামে অভিহিত হন।
ত্রিক শৈবাচার্য ক্ষেমরাজ বিজ্ঞান ভৈরব তন্ত্র/৯১নং শ্লোক এর টীকায় ব্যাখ্যা করছেন -
পরমেশ্বরের এই বিসর্গ শক্তিই সাক্ষাৎ সপ্তদশীকলা। (শক্তিসঙ্গম তন্ত্র মতে সপ্তদশী কলা ঊর্ধ্বকুণ্ডলিনী হিসেবে পরিচিত।) ইহা সাধকের মনের ভাব ও যোগের দ্বারা অষ্টাদশীকলায় রূপান্তরিত হয়। অন্যদিকে 'অকার' সাক্ষাৎ অনুত্তর তত্ত্ব পরাভৈরবস্বরূপ অদ্বিতীয় ব্রহ্মস্বরূপ। অকুল (বা অকুলাতীত) আদিনাথের এই বিসর্গ শক্তিকেই পরাশক্তি ও কৌলিকি শক্তি বলা হয়ে থাকে, যার থেকে সমগ্র জগৎ জাত হয়।।
উন্মনীর দুটি ভেদ রয়েছে - নির্বাণকলা ও বর্ণাবলী, কেননা মালা বর্ণের মানসিক জপের দ্বারাই একমাত্র নির্বাণ সম্ভব, সেই নির্বাণ প্রদায়িনী হলেন এই উন্মনী।
🍀মহাবিন্দু/পরবিন্দু-
"পরশিবরবিকরনিকরে প্রতিফলতি বিমর্শদর্পণে বিশদে | প্রতিরুচিরুচিরে কুণ্ড্যে চিত্তময়ে নিবিশতে মহাবিন্দুঃ || ”
অর্থাৎ পরমব্রহ্ম পরমশিব অনুত্তর ভট্টারক যখন সূর্যকিরণতূল্য নিজের প্রকাশময়তাকে নিজেরই বিমর্শময়ী হৃদয়-দর্পণে বা চিত্তে প্রতিফলিত করেন তখন সেই দর্পণচিত্তে মহাবিন্দুর অবির্ভাব হয়।
ইহাই সাক্ষাৎ বিসর্গের আদি রূপ, যা হতে বিসর্গের সৃজন হয়, কাহারো মত ইহার স্থান সহস্রারের একদম উর্ধ্বে শঙ্খিনী নাড়ির শেষ প্রান্তে আবার কাহারো মতে ইহার স্থান দ্বাদশান্তে অর্থাৎ শিখা ভাগের প্রান্ত দেশে। ইহাই সাক্ষাৎ মহাত্রিপুরাসুন্দরী বা শিবকামাসুন্দরী বা উমা হৈমবতী বা মাতৃসদ্ভাব, ইনিই পরমব্রহ্ম স্বরূপিনী, পরমশিবের বিমর্শ হৃদয় স্বরূপিনী। আবার ইহাকেই নটরাজ/চিদম্বর ক্ষেত্র হিসেবে কল্পনা করা হয় শ্রীচক্রের একদম কেন্দ্র বিন্দুতে। তন্ত্রে ইহাকে সকল নিষ্কল এর অতীত, শিবপদ বা পরমব্রহ্মপদ বলা হয়েছে। ইহা হতেই বিসর্গের প্রথম বিন্দুর সৃজন ঘটে। ইহাই মহাকামকলা স্বরূপা। শিব যোগীর ধ্যানলদ্ধ উপলব্ধিতে ইহাই অষ্টদশীকলা হিসেবে প্রতিভাত হয়।
✍️পরবিন্দু হতে নাদের উৎপত্তি এবং তা হতে সমগ্র সৃষ্টির উৎপত্তি -
অদ্বৈত শৈব তন্ত্র মতে মহাবিন্দু ---- বিন্দু বিসর্গ ---- কামকলা এর সৃষ্টি -
বিশ্বসৃষ্টির ইচ্ছার অর্থাৎ সৃসিক্ষার দরুন সেই তৎ ব্রহ্ম (সূক্ষ্ম পরাশক্তি বিশিষ্ট পরমশিব) যখন নিজ অর্ধাঙ্গিনী অভিন্না বিমর্শ হৃদয় দর্পণ স্বরূপা মহাবিন্দুকে অর্থাৎ পরাশক্তিকে বিলোকন (দৃষ্টিপাত) করেন, সেই মুহূর্তেই তিনি (পরমশিব) বিন্দুস্বরূপ (চন্দ্রস্বরূপ শুক্লবিন্দু, অ-কার) ধারণ করেন। সেই চন্দ্র (ইন্দু) স্বরূপ বিন্দুতে প্রবেশ পূর্বক সেই পরাশক্তি নিজেও রক্তবর্ণের বিন্দু (হ-কার, অগ্নিস্বরূপ রক্তবিন্দু) স্বরূপ ধারণ করেন। এই শুক্ল বিন্দু এবং রক্ত বিন্দু কেই একত্রে বলে বিসর্গ/ বিসর্গ শক্তি, ইহাই তন্ত্রান্তরে হার্ধকলা পদ বাচ্য। এই দুই বিন্দুর মিলনের দরুন উৎপন্ন স্ফীত বিন্দুই হল উচ্ছূন বিন্দু, ইহাই কামকলা (অ+হং=অহং পদ বাচ্য)।
শারদাতিলক তন্ত্র মতে , পরমশিবে সুপ্ত বিমর্শময়ী ইচ্ছাশক্তির স্ফূরণ হওয়ার ফলে নাদ (পরানাদ) উৎপন্ন হয় এবং তা হতে পরাশক্তিরূপিণী পরাবিন্দুর উৎপত্তি হয় । সেই পরশক্তিময় পরমবিন্দু পুনরায় ত্রিধাবিভক্ত হয়ে বিন্দু (অপরা), নাদ ও বীজ নামে অভিহিত হয়।
এই মহাবিন্দুই হচ্ছেন জ্যোতির্ময় পরমেশ্বর। সুতরাং দেখা যায়, বিন্দুই মহামায়া, মহাপ্রকৃতি, পরমেশ্বরী কামকলা-কুণ্ডলিনী, আবার পরমেশ্বরও, সেই কারণেই শিব আর শক্তিকে শৈব দর্শনে অভিন্ন ধরা হয়।।
✍️দ্বৈত শৈবতন্ত্র মতে বিন্দুর ব্যাখ্যা ও জগৎরূপে প্রসার -
চিৎরূপা (চৈতন্যস্বরূপা ) শক্তি-ব্যতীত পরমশিবের আর একটি অচিৎরূপা শক্তি আছে, যার নাম পরবিন্দু। এই বিন্দুর অপর নাম মহামায়া কারণ ইহা মায়ার ন্যায় জড় নয়। এই মহামায়ার নাম চিদাকাশ বা কুণ্ডলিনীও। চিৎরূপা-শক্তি সক্রিয়, ইহার প্রভাবে বিন্দুরূপা পরিগ্রহ শক্তিতে (পরিগ্রহ শক্তি বলতে বিন্দু বা মহামায়া বা চিদাকাশ বা কুণ্ডলিনীশক্তিকে বোঝানো হয়েছে ) ক্ষোভ (স্পন্দন) হয়। এই লহরীই বাইরে নাদ ও জ্যোতিঃরূপে প্রকাশ পায়। নাদ প্রকাশিত হয় বাক্ রূপে এবং জ্যোতির প্রকাশ হয় অর্থ-রূপে। বাক্-এর আবির্ভাব ক্রম হল পরা, পশাস্তী, মধ্যমা ও বৈখরী। এইভাবে বিন্দু বিক্ষুব্ধ বা স্পন্দিত হলে হয় নাদ বা কারণশব্দের (প্রণবের) সৃষ্টি ও বিকাশ। পূর্ণ পরমেশ্বরের স্বতন্ত্রশক্তির সাহায্যেই পরবিন্দু (কুণ্ডলিনী ) বিক্ষুব্ধ বা স্পন্দিত হয় । বিন্দু অব্যক্ত অবস্থায় অস্পদ বা স্পন্দহীন, অর্থাৎ কম্পনহীন। বিন্দুর এই অব্যক্ত-অবস্থাকে আমরা পরাবাক বলি। পরাবাকের পরের স্তর পশ্যন্তী। পশ্যন্তীর পর মধ্যমা। মধ্যমার পর বৈখরী। বিন্দুর তিন রূপে —ঈড়া পিঙ্গলা ও সুষুম্মার অধিপতি অগ্নি সোম ও সূর্য । অগ্নির স্পর্শে সোম (চন্দ্র) আসিলে সোম হতে ক্ষরণ হয়। সেই ক্ষরণ হতে অনন্ত প্রকারের সৃষ্টি হয়।
🍀শৈব তন্ত্রেই আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।পরমব্রহ্ম পরমশিবের ইচ্ছা শক্তির দরুণ পরাবিন্দুময় (supreme bindu) সেই অব্যক্ত অবস্থা ক্ষোভিত হয়। সেখান থেকে প্রকটিত হয় পরানাদ (সূক্ষ্ম শাস্ত্র জ্ঞান স্বরূপ)। সেই পরানাদ থেকে প্রকটিত হয় কুজাকৃতি বক্র বিন্দুতত্ত্ব (অপরা বিন্দু), যার প্রভা শরৎচন্দ্রের ন্যায়। এই বিন্দু পুনরায় পরশিবের ইচ্ছা শক্তি দ্বারা ক্ষোভিত হন এবং খণ্ড চন্দ্রাকৃতি আকৃতি লাভ করেন। সেই খণ্ড চন্দ্রাকৃতি বিন্দু থেকে প্রকটিত হয় চারটি শক্তি -
১. অম্বিকা শক্তি, ২.বামা, ৩. জ্যেষ্ঠা এবং ৪. রৌদ্রী শক্তি। তাছাড়া, সেই শুদ্ধমায়া স্বরূপ বিন্দু থেকে আরো ১৬ প্রকার শক্তি প্রকটিত হয় - ১. জয়া, ২. বিজয়া, ৩. অজিতা, ৪. অপরাজিতা, ৫. নিবৃত্তি, ৬. প্রতিষ্ঠা, ৭. বিদ্যা, ৮. শান্তি, ৯. ইন্দিকা, ১০. দীপিকা, ১১.রোচিকা, ১২. মোচিকা, ১৩. ব্যোমরূপা, ১৪. অনন্তা, ১৫. অনাথা এবং ১৬. অনাশ্রিতা। ৩৬ তত্ত্বের প্রথম তত্ত্ব শিব তত্ত্ব থেকে শেষতম তত্ত্ব পৃথিবী তত্ত্ব পর্যন্ত সমস্ত তত্ত্ব এই ১৬ প্রকার শক্তির দ্বারাই ব্যাপ্ত। এই ২০ প্রকার (৪ + ১৬ = ২০) শক্তির দ্বারাই ৫০ প্রকারের মাতৃকা বর্ণ নির্মিত।
তাই দ্বৈত শৈব দর্শন মতে এই বিন্দুই হল জগতের প্রকৃত উপাদান কারণ।
(নাদ ও বিন্দু সম্পর্কে আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা গুরুগম্য।)