194 খানি তন্ত্র শাস্ত্রের প্রকারভেদ
194 খানি তন্ত্র শাস্ত্রের প্রকারভেদ~~
তন্ত্রানুসারে ভারতবর্ষ তিনভাগে বিভক্ত। বিন্ধ্যাচল থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রদেশ বিষ্ণুক্রান্তা, বিন্ধ্যাচল থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত অশ্বক্রান্তা বা গজক্রান্তা এবং বিন্ধ্যাচল থেকে নেপাল, মহাচীন কাশ্মীর প্রভৃতি দেশ রথক্রান্তা নামে বিখ্যাত। প্রত্যেক ক্রান্তায় 64 খানি করে 192 খানি তন্ত্র সমগ্র ভারতে প্রচলিত রয়েছে।
‘তান্ত্রিক ঐতিহ্যে তিনটি স্রোত স্বীকৃত হয়– দক্ষিণ, বাম ও মধ্যম। দক্ষিণ স্রোতের অন্তর্গত তন্ত্রসমূহের নাম যোগিনীজাল, যোগিনীহৃদয়, মন্ত্রমালিনী, অঘোরেশী, অঘোরেশ্বরী, ক্রীড়াঘোরেশ্বরী, লাকিনীকল্প, মারিচী, মহামারিচী ও উগ্রবিদ্যাগণ। মধ্যম স্রোতের অন্তর্গত তন্ত্রসমূহ হচ্ছে বিজয়, নিশ্বাস, স্বায়ম্ভূব, বাতুল, বীরভদ্র, রৌরব, মাকুট ও বীরেশ। বাম স্রোতের তন্ত্র হচ্ছে চন্দ্রজ্ঞান, বিশ্ব, প্রোদ্গীত, ললিত, সিদ্ধ, সন্তান, সর্বোদ্গীত, কিরণ ও পরমেশ্বর। ব্রহ্মযামলের পরিশিষ্ট পিঙ্গলামতে দু’ধরনের তন্ত্রের উল্লেখ আছে, কামরূপী ও উড্ডিয়ানী। অপর একটি পরিশিষ্ট জয়দ্রথযামলে তিন ধরনের মহাযোগী তন্ত্রের উল্লেখ আছে যথা মঙ্গলাষ্টক, চক্রাষ্টক ও শিখাষ্টক। মহাসিদ্ধসার তন্ত্রে ভারতবর্ষকে তিনটি ভৌগোলিক ভাগে ভাগ করা হয়েছে– বিষ্ণুক্রান্তা, রথক্রান্তা ও অশ্বক্রান্তা, প্রতিটি অঞ্চলে চৌষট্টিটি করে তন্ত্র বর্তমান। শক্তিসঙ্গমতন্ত্রের মতে বিন্ধ্য থেকে যবদ্বীপ পর্যন্ত এলাকা বিষ্ণুক্রান্তা, উত্তরে বিন্ধ্য থেকে মহাচীন পর্যন্ত রথক্রান্তা এবং পশ্চিমের অবশিষ্ট অংশ অশ্বক্রান্তা। ষট্সম্ভবরহস্যে চারটি তন্ত্র সম্প্রদায়ের কথা উল্লিখিত হয়েছে– গৌড়, কেরল, কাশ্মীর ও বিলাস। বাস্তবে মোটামুটি তিনটি তান্ত্রিক সম্প্রদায় স্বীকৃত– গৌড়ীয়, কাশ্মীরীয় এবং দ্রাবিড়ীয়।’
কাশ্মীর শৈববাদের গ্রন্থসমূহ কাশ্মীরীয় তন্ত্রের অন্তর্গত। অনুরূপভাবে শৈব সিদ্ধান্তীদের রচনাসমূহ দ্রাবিড়ীয় তন্ত্রের অন্তর্গত।… গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের গ্রন্থসমূহের মধ্যে কৌলাবলী, গান্ধর্ব, কুলার্ণব, ফেৎকারিণী, সনৎকুমার, মহাচীনাচার, কামাখ্যা, গুপ্তসাধন, মাতৃকাভেদ, তারারহস্য, গায়ত্রী, গৌতমীয়, মহানির্বাণ, শ্যামারহস্য, ত্রিপুরাসারসমুচ্চয়, উড্ডামেশ্বর, নিরুত্তর, কামধেনু, কঙ্কালমালিনী, নীলতন্ত্র, নির্বাণ, বৃহন্নীল, রুদ্রযামল, যোগিনী, যোগিনীহৃদয়, তন্ত্ররাজ, প্রভৃতি। জয়দ্রথতন্ত্রলোকে (১/১৮) কথিত হয়েছে যে শিবের যোগিনী মুখ হতে চৌষট্টিটি ভৈরব আগম নির্গত হয়েছিল যেগুলি অদ্বৈতপন্থী ছিল। এ ভিন্ন দশটি দ্বৈতপন্থী শৈব আগম এবং আঠারোটি মিশ্র মতবাদের রৌদ্র আগম বর্তমান ছিল। শঙ্করের উপর আরোপিত সৌন্দর্যলহরীতে (৫/৩৭) চৌষট্টিটি তন্ত্রের উল্লেখ আছে, যেগুলির নামের তালিকা লক্ষ্মীধরের ভাষ্যে দেওয়া আছে।
তন্ত্রাচার ‘চীনাচার’ নামে সুপ্রসিদ্ধ; বশিষ্ঠ চীন বা মহাচীন হইতে এই তন্ত্রাচার লাভ করিয়াছিলেন, এইরূপ প্রসিদ্ধিও সুপ্রচলিত। এই-সকল কিংবদন্তীও আমাদের অনুমানেরই পরিপোষক বলিয়া মনে হয়। আমরা লক্ষ্য করিতে পারি, প্রাচীন তন্ত্র অনেকগুলিই কাশ্মীরে রচিত; ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানেও কিছু কিছু তন্ত্র রচিত হইলেও বঙ্গ-কামরূপ মুখ্যভাবে পরবর্তী তন্ত্রের রচনাস্থান– নেপাল-ভূটান-তিব্বত-অঞ্চলে এগুলির বহুল প্রচার এবং অদ্যাবধি সংরক্ষণ। ইহা ব্যতীতও পার্শ্বপ্রমাণরূপে আমরা আরো কতকগুলি তথ্যের উল্লেখ করিতে পারি। তন্ত্রোক্ত দেহস্থ ষট্চক্রের পরিকল্পনা সুপ্রসিদ্ধ; নিম্নতম মূলাধার চক্র হইতে আরম্ভ করিয়া ভ্রূমধ্যস্থ আজ্ঞাচক্রকে লইয়া এই ষট্চক্র। এই ছয়টি চক্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রহিয়াছেন– নিম্ন হইতে আরম্ভ করিয়া এই দেবীগণ যথাক্রমে হইলেন ডাকিনী, রাকিণী, লাকিনী, কাকিনী, শাকিনী এবং হাকিনী। এই নামগুলির প্রতি লক্ষ্য করিলেই বেশ বোঝা যায় এই নামগুলি সম্ভবতঃ সংস্কৃত নহে। পক্ষান্তরে দেখিতে পাই, ‘ডাক’ কথাটি তিব্বতী, অর্থ জ্ঞানী; ইহারই স্ত্রীলিঙ্গে ডাকিনী। আমাদের ‘ডাক ও খনার বচনে’র ডাকের বচন কথার মূল অর্থ বোধহয় জ্ঞানীর বচন। ডাকিনী কথার মূল অর্থ বোধহয় ছিল ‘গুহ্যজ্ঞানসম্পন্না’; আমাদের বাঙলা ‘ডাইনী’ কথার মধ্যে তাহার রেশ আছে; মধ্যযুগের নাথসাহিত্যের রাজা গোপীচাঁদের মাতা ময়নামতী ‘মহাজ্ঞান’সম্পন্না এই-জাতীয় ‘ডাইনী’ ছিলেন। সুতরাং মনে হয়, এই ‘ডাকিনী’ দেবী কোনো নিগূঢ়জ্ঞানসম্পন্না তিব্বতী দেবী হইবেন। ‘লাকিনী’ ও ‘হাকিনী’ নামে ভারতবর্ষের অন্যত্র কোনো দেবীর উল্লেখ পাইতেছি না, কিন্তু ভূটানে ‘লাকিনী’ ও ‘হাকিনী’ দেবীর সন্ধান পাওয়া যাইতেছে। তাহা হইলে তিব্বত-নেপাল-ভূটান-অঞ্চলের আঞ্চলিক দেবীরাই কি তন্ত্রের ষট্চক্রের মধ্যে আপন আপন আসন প্রতিষ্ঠিত করিয়া লইয়াছেন?’
‘এই প্রসঙ্গে আরো একটি তথ্যের প্রতি পণ্ডিতগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। তন্ত্রের মধ্যে মন্ত্রের অতিশয় প্রাধান্য। এই মন্ত্রতত্ত্বের বিভিন্ন দিক্ রহিয়াছে। কিন্তু সেই-সকল তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাকে অশ্রদ্ধা না করিয়াও কতকগুলি ঐতিহাসিক সত্যের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাইতে পারে। তন্ত্রের মন্ত্রসমূহের মধ্যে আমরা বীজমন্ত্রের নানাভাবে উল্লেখ দেখিতে পাই। এই বীজমন্ত্রগুলি সাধারণতঃ একাক্ষরী। এই একাক্ষরী বীজমন্ত্রসমূহের মধ্যে প্রণব বা ‘ওঁ’ সুপ্রসিদ্ধ বৈদিক মন্ত্র। অন্য মন্ত্রগুলি বৈদিক বলিয়া মনে হয় না। হ্রীং ক্লীং হৈঁ ক্রীং প্রভৃতি মন্ত্র মূলতঃ সংস্কৃত ভাষাজাত কি-না এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশের অবকাশ আছে। এই বীজমন্ত্র ব্যতীত তন্ত্রের মধ্যে আমরা আর-এক রকমের মন্ত্রমালা পাই, এই মন্ত্রগুলি সাধারণতঃ দ্বিমাত্রিক– ইহাদের কোনো অর্থ আমরা বুঝিতে পারি না। মহাযানী বৌদ্ধ দার্শনিক অসঙ্গ একস্থানে বলিয়াছেন যে, এই অর্থহীনতাই ইহাদের যথার্থ তাৎপর্য। অবশ্য অর্থহীন মন্ত্র অথর্বাদি বেদের মধ্যেও পাওয়া যায়। তন্ত্রে যে একাক্ষরী বীজমন্ত্রের এবং দ্ব্যক্ষরী মন্ত্রমালার বহুল ব্যবহার পাওয়া যায় সেগুলি সম্বন্ধে এমন কথা মনে করা কি একান্ত ভ্রমাত্মক হইবে যে, এগুলি আমাদের পূর্বোক্ত তান্ত্রিক অঞ্চলের কোনো প্রাচীনকালে প্রচলিত ভাষার লুপ্তাবশেষ? আমরা সাধারণভাবে যাহাকে চীনাঞ্চল বা মহাচীনাঞ্চল বলিয়া ইঙ্গিত করিয়াছি সেখানকার ভাষায় একাক্ষরিত্ব বা দ্ব্যক্ষরিত্বের প্রাধান্যের কথাও আমাদের এই প্রসঙ্গে স্মরণ রাখিতে হইবে।’- (ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য)
তন্ত্রস্য লক্ষণং। সর্গশ্চ প্রতিসর্গশ্চ তন্ত্রনির্ণয় এব চ।। দেবতানাঞ্চ সংস্থানং তীর্থানাঞ্চৈব বর্ণনং। তথৈবাশ্রমধর্ম্মশ্চ বিপ্রসংস্থানমেব চ। সংস্থানঞ্চৈব ভূতানাং যন্ত্রাণাঞ্চৈব নির্ণয়ঃ। উৎপত্তির্বিবুধানাঞ্চতরূণাং কল্পসংজ্ঞিতং।। সংস্থানং জ্যোতিষাঞ্চৈব পুরাণাখ্যানমেব চ। কোষস্য কথনঞ্চৈব ব্রতানাং পরিভাষণং।। শৌচাশৌচস্য চাখ্যানং নরকাণাঞ্চ বর্ণনং। হরচক্রস্য চাখ্যানং স্ত্রীপুংসোশ্চৈব লক্ষণং।। রাজধর্ম্মেঅ দানধর্ম্মো যুগধর্ম্মস্তথৈব চ। ব্যবহারঃ কথ্যতে চ তথা চাধ্যাত্মবর্ণনং।। ইত্যাদিলক্ষণৈর্যুক্তং তন্ত্রমিত্যভিধীয়তে।- (বৃহৎতন্ত্রসারঃ)
ভাবার্থ :
সৃষ্টি ও প্রলয় প্রকরণ, তন্ত্র নির্ণয়, দেবতা সংস্থান, তীর্থবর্ণন, ব্রহ্মচর্য্যাদি আশ্রম ধর্ম, ব্রাহ্মণাদি বর্ণের কর্তব্যাকর্তব্য, প্রাণিসংস্থান, পুরাণকথন, কোষকথন, ব্রতবর্ণন, শৌচাশৌচ কথন, নরক বর্ণন, হরচক্র কথন, স্ত্রীপুরুষ লক্ষণ, রাজধর্ম, দানধর্ম, যুগধর্ম, ব্যবহার ও আত্মনির্ণয় ইত্যাদি বিষয় যে শাস্ত্রে বর্ণিত আছে তাহাকে তন্ত্র শাস্ত্র বলে।
সদাশিবের পাঁচটি মুখ থেকে পাঁচপ্রকার তন্ত্রের উদ্ভব। পূর্ব মুখের নাম ‘সদ্যোজাত’। এই মুখ থেকে প্রকাশিত তন্ত্রগুলি ‘পূর্বাম্নায়’ নামে খ্যাত। দক্ষিণ মুখের নাম ‘অঘোর’। এই মুখ থেকে নিঃসৃত তন্ত্রগুলির নাম ‘দক্ষিণাম্নায়’। পশ্চিম মুখের নাম ‘তৎপুরুষ’। এই মুখ থেকে প্রকাশিত তন্ত্রসমূহের নাম ‘পশ্চিমাম্নায়’। ‘বামদেব’ নামক উত্তর মুখ থেকে উদ্ভূত তন্ত্রগুলিকে ‘উত্তরাম্নায়’ বলে। ঊর্ধ্ব মুখের নাম ‘ঈশান’। এই মুখ থেকে বিনির্গত তন্ত্রসমূহের নাম ‘ঊর্ধ্বাম্নায়’।
সদাশিব ও পার্বতী অভিন্ন। সদাশিব তন্ত্রের উপদেশে পার্বতীর সংশয় ভঞ্জন করেছেন। কোন কোন স্থলে জিজ্ঞাসু মহাদেবকে পার্বতী উপদেশ দিয়েছেন। যেক্ষেত্রে বক্তা শিব এবং শ্রোতা পার্বতী, সেগুলোকে বলে আগম। আর যেক্ষেত্রে বক্ত্রী গিরিজা এবং শ্রোতা শিব, সেগুলো নিগম।
আবার তান্ত্রিক গ্রন্থকারদের কেউ কেউ বলে থাকেন, দক্ষিণাচারের সাধনশাস্ত্রের নাম আগম এবং বামাচার-সম্প্রদায়ের সাধনশাস্ত্রের নাম নিগম।
বৃহৎতন্ত্রসার গ্রন্থের ভূমিকায় আমরা তন্ত্রের এক দীর্ঘ তালিকা পাই, যেমন– সিদ্ধেশ্বর তন্ত্র, মহাতন্ত্র, কালীতন্ত্র, কুলার্ণব, জ্ঞানার্ণব, নীলতন্ত্র, ফেৎকারিণী, দেব্যাগম, উত্তরা, শ্রীক্রম, সিদ্ধিজামল, মৎস্যসূক্ত, সিদ্ধসার, সিদ্ধসারস্বত, বারাহী, যোগিনী, গণেশবিহর্ষিণী, নিত্যাতন্ত্র, শিবাগম, চামুণ্ডা, মুণ্ডমালা, হংসমাহেশ্বর, নিরুত্তর, কুলপ্রকাশ, কল্প, গান্ধর্ব্ব, ক্রিয়াসার, নিবন্ধ, সম্মোহন, তন্ত্ররাজ, ললিতাখ্য, রাধা, মালিনী, রুদ্রযামল, বৃহৎশ্রীক্রম, গবাক্ষ, সুকুমুদিনী, বিশুদ্ধেশ্বর, মালিনী, বিজয়, সময়াচার, ভৈরবী, যোগিনীহৃদয়, ভৈরব, সনৎকুমার, যোনিতন্ত্র, নবরত্নেশ্বর, কুলচূড়ামণি, ভাবচূড়ামণি, দেবপ্রকাশ, কামাখ্যা, কামধেনু, কুমারী, ভূতডামর, মালিনীবিজয়, যামল, ব্রহ্মযামল, বিশ্বসার, মহাকাল, কুলামৃত, কুলোড্ডীশ, কুব্জিকা, তন্ত্রচিন্তামণি, মহিষমর্দ্দিনী, মাতৃকা, মহানির্ব্বাণ, মহানীল, মহাকালসংহিতা, মেরু, ডামর, বীরভদ্র, বিজয়চিন্তামণি, একজটিকা, নির্ব্বাণ, ত্রিপুরা, কালীবিলাস, বরদা, বাসুদেবরহস্য, বৃহৎগৌতমীয়, বর্ণোদ্ধৃত, বিষ্ণুজামল, বৃহন্নীল, বৃহৎযোনি, রহস্য, ব্রহ্মজ্ঞান, বামকেশ্বর, ব্রহ্মযামল, অদ্বৈত্য, বর্ণবিলাস, পুরশ্চরণচন্দ্রিকা, রসোল্লাস, পঞ্চদশী, পিচ্ছিলা, প্রপঞ্চসার, পরমেশ্বর, হংসাদ্য, নবরত্নেশ্বর, নিত্য, লীল, নারায়ণী, নারদীয়, নাগার্জ্জান, দক্ষিণামূর্ত্তি, সংহিতা, দত্তাত্রেয়, অষ্টাবক্র, যক্ষিণী, যোগসারার্ণব, অনুত্তম, যোগেশ্বর, যামলভৈরব, রাজরাজেশ্বরী, রেবতী, রামার্চ্চনচন্দ্রিকা, স্ববোদয়, ইন্দ্রজাল, কালীতন্ত্র, কালীকুলসর্ব্বস্ব, কুমারী, কৃকলাশদীপিকা, কঙ্কালমালিনী, কালোত্তর, কুব্জিকা, কুলার্ণব, কল্পসূত্র, গৌরীতন্ত্র, গন্ধর্ব্বতন্ত্র, শ্রীগণেশ, বিমর্ষিণী, গুরুতন্ত্র, গায়ত্রী, গবাক্ষ, গবাক্ষসংহিতা, জ্ঞানভাষ্য, অন্নদাকল্প, উৎপত্তি, উত্তর, উড্ডীশ, যক্ষডামর, সরস্বতী, শারদা, শক্তিসঙ্গম, আগমসর্ব্বস্ব, চীনাচার, তারারহস্য, শ্রীশ্যামারহস্য, স্কন্দযামল, নিগমকল্পদ্রুম, লতা, লতাসার, উর্দ্ধাম্নার। সৈন্ধোক্ত, কাপিল, অদ্ভূত, জৈমিনী, বশিষ্ঠ, কপিল, নারদ, গর্গ, পুলস্ত, ভার্গব, সিদ্ধ, যাজ্ঞবল্ক, ভৃগু, শুক্র, বৃহস্পতি ইত্যাদি।
তবে তন্ত্রের বিশেষ অর্থানুযায়ী তাকে বেদবিহিত ক্রিয়াদি থেকে পৃথক বুঝতে হবে, এবং যজ্ঞাদি বৈদিক ক্রিয়ানুষ্ঠান দেববিগ্রহ পূজাদি তান্ত্রিক ধর্মাচরণ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভিন্ন ভিন্ন লৌকিক দেব-দেবীর উপাসনার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ-সকল দেবতাকে আশ্রয় করে যে-সকল ধর্মাচারক্রম উদ্ভূত হয়, সেগুলোকে ন্যায্যত অবৈদিক পর্যায়ে ফেলা হয়ে থাকে। এদিক থেকে বিচার করলে গাণপত্য, বৈষ্ণব, শৈব, সৌর ইত্যাদি পূজাক্রম শাক্ত পূজাক্রমের মতো তান্ত্রিক পর্যায়ভুক্ত বলেই বিবেচনা করা যেতে পারে। কিছু সংগৃহিত পাঞ্চরাত্র গ্রন্থাবলীর তালিকায় তন্ত্রসাগর, পাদ্মসংহিতাতন্ত্র, পাদ্মতন্ত্র, লক্ষ্মীতন্ত্র প্রভৃতি নাম পাওয়া যায়। এভাবে সৌর ও গাণপত্য ধর্মমত সংক্রান্ত কোনও কোনও গ্রন্থ তন্ত্র নামে অভিহিত হতে পারে।
তিনি শঙ্কর আগমাচার্য নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। তাঁর অন্যান্য রচনা হলো শিবার্চনমহারত্ন, শৈবরত্ন, কুলমুলাবতার, ক্রমস্তব প্রভৃতি। মন্ত্রমহোদধির রচয়িতা যে মহীধর তা উক্ত গ্রন্থের মধ্যেই স্পষ্টভাষায় লিখিত আছে।
‘মন্ত্রমহোদধি ন্যূনাধিক দ্বাবিংশ তরঙ্গে বিভক্ত, এবং ইহাতে তান্ত্রিক ধর্মাচরণ সংক্রান্ত বহু তথ্য লিপিবদ্ধ আছে। ইহার প্রথম তরঙ্গের একটি শ্লোকে পঞ্চোপাসনার কথা এইরূপ ভাবে লিখিত দেখা যায়– বিষ্ণুশিবোগণেশার্কো দুর্গা পঞ্চৈব দেবতাঃ। আরাধ্যাঃ সিদ্ধিকামেন তন্ত্রমন্ত্রৈর্যথোদিতম্ ।। অন্যান্য পটলে গণেশ মন্ত্র, কালীসুমূখী মন্ত্র, তারা মন্ত্র, ছিন্নমস্তাদিকথন, শ্যামা মন্ত্র, মহাপূর্ণা মন্ত্র, ষট্কর্মাদি নিরূপণ, হনুমন্মন্ত্র, বিষ্ণু, শিব, কার্তবীর্যাদি মন্ত্র নিরূপণ, এবং স্নান, পূজা, পবিত্রার্চন, মন্ত্রশোধন, সূন্দরী (ষোড়শী) পূজন ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ের অবতারণা করা হইয়াছে। মহাতন্ত্র নামে অভিহিত মৎস্যসূক্ত মহারাজাধিরাজ লক্ষ্মণসেনের ধর্মাধ্যক্ষ পণ্ডিত হলায়ুধ মিশ্রের রচনা। ইহা চতুঃষষ্টি পটলে বিভক্ত একটি প্রামাণিক তান্ত্রিক গ্রন্থ। ইহাতেও নানাবিধ তান্ত্রিক ধর্মাচরণের কথা আছে, এবং মহীধর প্রণীত মন্ত্রমহোদধিতে যেমন দশমহাবিদ্যার কালী, তারা, ষোড়শী ও ছিন্নমস্তার নাম পাওয়া যায়, তেমন মৎস্যসূক্তের ষষ্টিতম পটলে আর একটি মহাবিদ্যা মাতঙ্গিনীর (মাতঙ্গী) নামের উল্লেখ আছে। এই পটলে মাতঙ্গিনীবিদ্যার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। এই গ্রন্থের একষষ্টিতম পটলের বিষয়বস্তু হইতেছে সর্বগ্রহনিবারিণী মহাবিদ্যা সংক্রান্ত; কিন্তু ইহাতে দশমহাবিদ্যার অন্য নামগুলি পাওয়া যায় না। পরবর্তীর পটলে অপরাজিতার নাম আছে, এবং গ্রন্থের অন্যত্র ছয়টি মাতৃকা ও তাঁহাদের স্থানের কথা আছে, যথা– ব্রহ্মাণী (শিরে), মাহেশ্বরী (নেত্রে), কৌমারী (কর্ণে), বারাহী (উদরে), ইন্দ্রাণী (নাভীতে) এবং চামুণ্ডা (গুহ্যে); ইহা লক্ষ্য করিবার বিষয় যে এ প্রসঙ্গে বৈষ্ণবীর নাম করা হয় নাই।…’
‘এই বিশাল সাহিত্যের কোনও কোনও অংশের সহিত ভারতীয় অনার্য ও তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর লোকদের ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল বলিয়া কেহ কেহ মনে করেন, কারণ এগুলি অত্যন্ত অশুদ্ধ সংস্কৃতে রচিত, এবং ইহাদের বিষয়বস্তু নিম্নস্তরের যাদুবিদ্যা সংক্রান্ত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় পশ্চিমাম্নায়ের অন্তর্গত কুব্জিকামত সম্বন্ধে বলিয়াছেন যে ভেলক (ভেল্কী) বা নিম্নস্তরের যাদুবিদ্যায় অশেষ পারদর্শিতা অর্জনই এইসব তান্ত্রিক উপাসকের পরম লক্ষ্য ছিল, এবং যাঁহারা এ বিষয়ে কৃতকার্য হইতেন তাঁহাদিগকে নাথ বলা হইত; নাথপন্থীরা সমাজের নিম্নস্তরের লোক ছিলেন, ও এ কারণেই ইহাদিগের দ্বারা রচিত তান্ত্রিক গ্রন্থসমূহের সংস্কৃত ভাষা অশুদ্ধ, ব্যাকরণবহির্ভূত ও দুর্বোধ্য ছিল। ১৬৪২ খৃষ্টাব্দে লিখিত জয়দ্রথযামল সম্বন্ধে তিনি বলিয়াছেন যে ইহার বিষয়বস্তু সাধারণতঃ কুলার্ণব তন্ত্র হইতে গৃহীত। ইহাতে লিখিত আছে যে পর্ণশবরী দেবীর পূজা হয় কুম্ভকারের নয় কলুর গৃহে অনুষ্ঠিত হইবে, এবং ইহারা হিন্দুসমাজের নিম্নস্তরে অবস্থিত।।