শৈবাগমতন্ত্রের সাধনা অতি উচ্চকোটির সাধনা
শৈবাগমতন্ত্রের সাধনা অতি উচ্চকোটির সাধনা । বৈদিক সাধনার চেয়ে তা কোন অংশে ছোট বা হেয় নয়। সর্বাংশে বরং শ্রেয়তর। "
1500-1600 শতকের পর ছাপানো কিছু তন্ত্র পড়ে বঙ্গ, উড়িষ্যা, আসাম, ত্রিপুরার একদল শাক্ত আজকাল দাবী করে বেড়ান যে- শৈব আচার নাকি শাক্ত আচার হতে নিকৃষ্ট, শাক্ত আচারই একমাত্র কৌলপন্থী এবং উহাই শ্রেষ্ঠ। শৈবরা নাকি পশুমার্গী-------ইহা নাকি সাক্ষাৎ শিব বাক্য।
মাচার, কৌলআচার, কাপালিক আচার (মহাব্রত, কাপাল শাস্ত্র ভিত্তিক), অঘোরাচার, অতিমার্গিক আচার (পাশুপত শাস্ত্র ও লাকুলাগম ভিত্তিক), কৌল আচার, শৈবাচার, বেদাচার,সময়াচার, যোগাচার, মতাচার, ত্রিকাচার ইত্যাদি সব কিছুই শৈব আচারের মধ্যে আসে।
কারণ শৈব তন্ত্রের বিশাল সাগরের মধ্যে উপরিউক্ত সকল আচারই বিদ্যমান।
আজ শাক্তরা যেটিকে মহাচীনাচার বলছে সেটির উৎপত্তিই হয় - প্রাচীন অতিমার্গিক শৈব কাপালিক, পাশুপত, লাকুল সম্প্রদায়, সোম সিদ্ধান্ত, রৌদ্র সিদ্ধান্ত - এরা মূলত ছিল শিবের উগ্র ভৈরব স্বরূপের উপাসক।
অঘোর আচারের উৎপত্তিও শৈবদের থেকেই, ইহা নাথ পরম্পরা থেকে এসেছে। ইহার আদি প্রবর্তক আদিনাথ শিব স্বয়ং। ইহা মন্ত্রমার্গিক বীরাচারী শৈব । এরা ছিল মূলত অঘোর শিবের উপাসক।
কৌল সম্প্রদায় এসেছে , প্রাচীন শৈব নাথ যোগীদের থেকেই। কৌল ঘরানার সূত্রপাত হয় - অর্ধত্র্যম্বক মঠিকা থেকে, যিনি কাশ্মীর ত্রিক ধারার প্রাচীন আচার্য ত্র্যম্বকাদিত্যের কন্যা ছিলেন, ইহার উল্লেখ সাক্ষাৎ আচার্য অভিনবগুপ্ত তাঁর তন্ত্রালোকে করে গিয়েছেন। তাছাড়া কৌল সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রাচীন আচার্য ছিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, যিনি চার যুগেই চার যুগ নাথ হিসেবেই বিদ্যমান ছিলেন (কূর্মনাথ, মেষনাথ, খগেন্দ্রনাথ ও মীননাথ, চার যুগেই মৎস্যেন্দ্রনাথের উপস্থিতি - ইহা নাথ পরম্পরার মান্যতা)। তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ আদিনাথের শিষ্য এবং সত্যযুগে তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ শিবমানস পুত্র, যার উল্লেখ তাঁর রচিত ' শাবর চিন্তামণি ' তেই পাওয়া যায়, তাছাড়া মৎস্যেন্দ্র সংহিতা, মীনচেতন, মৎচরিত এও এর উল্লেখ আছে, এমনকি গোরক্ষ পুরাণ ও স্কন্দ পুরাণের নাগর খণ্ডেও মৎস্যেন্দ্রনাথ এর কলি পূর্ববর্তী যুগে অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে, যিনি সাক্ষাৎ আদিনাথের কাছ থেকে কৌলজ্ঞান প্রাপ্ত করেন। তাই কৌল মানেই যে সেটি শাক্ত ঘরানা হবে, তার কোনো মানে নেই, কারণ কুল/কৌল মূলত শৈবদেরই । যদিও পরবর্তীতে ইহা শাক্ত কেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে, সেটা আলাদা বিষয়।
এই প্রাচীন শৈব কুল/ কৌল ঘরানা থেকেই কাশ্মীর ক্রমকালি ঘরানার সৃজন হয়, বাতুলনাথ, নিষ্ক্রিয়ানন্দনাথ, গন্ধমাদন প্রমুখ প্রাচীন আচার্যদের দ্বারা এবং আধুনিক ত্রিক আচার্য সহ আচার্য অভিনবগুপ্ত, আচার্য সোমানন্দপাদ এর মত যারা প্রাচীন ত্রিক আচার্য ছিলেন - তারাও এই ক্রম ও কুল ঘরানাকে ত্রিক শৈব ঘরানার অন্তর্ভুক্ত হিসেবেই মান্যতা দিয়ে যান। ক্রম ঘরানা হল কেননা ক্রম মূল তন্ত্র জয়দ্রথযামল/ শিরচ্ছেদ তন্ত্র হল একটি ভৈরব স্রোতের শৈব তন্ত্র এবং ক্রমর মূল প্রোথিত রয়েছে সেই কুল যেটিও একটি শৈব ছিল।
মন্ত্রমার্গিক কাপালিক সম্প্রদায়ও এসেছে নাথ শৈব যোগীদের থেকে ।
যোগাচার, হঠযোগ, রাজযোগ, রাজাধিরাজযোগ, কুণ্ডলিনী যোগ, নাদানুসন্ধন, কায়াসাধন -- এসবও এসেছে নাথ শৈবদের থেকে।
শ্রীবিদ্যা উপাসনা এর অন্যতম আচার সময়াচার এর ভিত্তিই হল - যোগাচার এ পুজো এবং ষট্চক্র অর্চনা, বিন্দু অবস্থায় সাধকের চিত্ত এর অবস্থান, সুতরাং ইহারও মূল শৈব আচারেই নিহিত। ললিত আগম, মুকুট আগম সহ একাধিক লুপ্ত শৈব আগমে শ্রীচক্র উপাসনার গুপ্ত পদ্ধতিও নিহিত ছিল বলে মান্যতা রয়েছে । এই শ্রীকুল পরে শাক্তদের দক্ষিণাম্নায়ে স্থান পায় ।
আর বামস্রোত তথা উত্তরাম্নায়ও মূলত প্রাচীন শৈব ক্রমই বটে, এই উত্তরাম্নায় এর অন্তর্গত গুরত্বপূর্ণ শৈব তন্ত্রগুলি হল - মহাসম্মোহন তন্ত্র, ন্যায়োত্তর তন্ত্র, মহারুদ্র, নেত্র তন্ত্র ইত্যাদি। টুম্বুরু ভৈরব কুল শৈবরাও এই উত্তরাম্নায় এর মধ্যে পড়ে, সাথে ত্রিক শৈবদের পুরো ক্রমকালী ঘরানা উত্তরাম্নায় এর মধ্যে পড়ে।
সুতরাং, শৈব আচারই পুরো ষড়াম্নায় জুড়েই ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে । এই শৈব আচারেরই বিভিন্ন পর্যায় হল - বেদাচার (নৈগমিক/শ্রৌত শৈব), বামাচার, কৌল আচার, কাপালিক আচার শুদ্ধ শৈব সিদ্ধান্তাচার, যোগাচার, অঘোরাচার ইত্যাদি । এর সপক্ষে শাস্ত্র প্রমাণ - শ্রীকণ্ঠী সংহিতা, পূর্বকামিকাগম, শ্রীনেত্রতন্ত্র, সিদ্ধান্তশিখামণি, নিঃশ্বাস তত্ত্ব সংহিতা, জয়দ্রথযামল, দীপ্তাগম, তন্ত্রালোক, প্রতিষ্ঠালক্ষণসারসমুচ্চয় ইত্যাদি শৈব শাস্ত্রে পাওয়া যায়।
উদাহরণ স্বরূপ - শৈবতন্ত্র নেত্রতন্ত্র থেকে নীচে দেওয়া হল -
" গারুড়ে মাতৃতন্ত্রে চ বামে স্রোতসি দক্ষিণে |
জেষ্ঠে চণ্ডাসিধারে চ প্রত্যক্ষফলদা ক্রিযা || ".....(শ্রীনেত্র তন্ত্র/16/76)
" গারুড়ে পূর্বস্মিন্, মাতৃতন্ত্রাদৌ পশ্চিমে, জযাদিনযে বামে,
ভৈরবশাস্ত্রে চ দক্ষিণে, চণ্ডাসিধারাদাবূর্দ্ধে,
জেষ্ঠে চ মতকূলাদৌ রহস্যে স্রোতসি "...... (শ্রীনেত্র তন্ত্র/16/76)
সদাশিবের তৎপুরুষ মুখ থেকে বেরিয়েছিল – গড়ুড় তন্ত্র( 24 সংখ্যক), বামদেব মুখ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল বাম তন্ত্রের (24 সংখ্যক) , সদ্যোজাত মুখ থেকে বেরিয়েছিল কৌল সহ 20 টি ভূত তন্ত্র , অঘোর মুখ থেকে নির্গত হয়েছিল দুই শ্রেণীর ভৈরব তন্ত্র এবং ঈশান মুখ থেকে বেরিয়েছিল 28 টি বেদের অনুকূল সিদ্ধান্তাগম ।....( প্রথমঃ পটলঃ/পূর্বকামিকাগম/শ্লোক নং 22-27 )
এই সব প্রাচীন তন্ত্রে ও প্রাচীন শৈব তন্ত্রাচার্যদের ভাষ্যমতে এটা জলের মত স্পষ্ট যে, ষড়াম্নায় এর ধারণাটিই শৈব তন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত, নব্য রচিত কোনো শাক্তবাদী তন্ত্রের সাথে নয়, কারণ প্রাচীন আচার্যরা এ প্রসঙ্গে কোনো শাক্ত আগমের নাম উল্লেখ করে নি।
তাই শৈবাচারকে পশ্বাচার বলা নিতান্তই মূর্খামির পরাকাষ্ঠা ।
জগতে শাস্ত্র বহু রয়েছে, মত বহু রয়েছে। এক এক শাস্ত্রে এক এক রকমের কথা লক্ষ্য করা যায়, প্রত্যেক তন্ত্রই নিজ নিজ আচার কে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করে। সুতরাং কোন মতটি গ্রহণযোগ্য আর কোন মতটি গ্রহণযোগ্য নয় সেটির মীমাংসা নির্ধারিত হবে প্রাচীন আচার্যের মান্যতার নিরিখে। আপ্ত পুরুষের বচনই শব্দপ্রমাণ হিসেবে পরিগণিত হয়।
" বেদাচ্ছৈবং ততো বামং ততো দক্ষং ততো কুলম্ |
ততো মতং ততশ্চাপি ত্রিকং সর্বোত্তমং পরম্ ||
বামমার্গাভিষিক্তোঽপি দৈশিকঃ পরতত্ত্ববিৎ |
ক্রমাদ্ভৈরবতন্ত্রেষু পুনঃ সংস্কারমর্হতি || "....
(পরাত্রিংশিকা বিবৃতি/বিম্বভাগ/ ৪নং শ্লোকের টীকা এবং তন্ত্রালোক বিবেক)
ব্যাখ্যা - বেদাচার হতে শৈবাচার (দ্বৈত শৈব) উত্তম, শৈবাচার হতে বামাচার উত্তম, বামাচার হতে দক্ষিণাচার উত্তম, দক্ষিণাচার হতে কুলাচার উত্তম, কুলাচার হতে মতাচার উত্তম কিন্তু এসবের থেকে ত্রিকাচার সর্বোত্তম। বামাচার মার্গী কোনো ব্যক্তি যদি বামাচারে আচার্য দীক্ষা প্রাপ্ত করে পরমতত্ত্ব সম্পর্কে অবগত হয়ে থাকেন, সেই ব্যক্তিকেও ভৈরব আগম মার্গে (ত্রিক শৈবাগম) অধিকারী হতে গেলে ত্ৰিক মার্গে বিশেষ ক্রম অনুসারে দীক্ষা গ্রহণের দরকার পড়বে। বেদাচারের চেয়ে উত্তম যে শৈবাচার তা মূলত দ্বৈতভাবাপন্ন শৈবাচার, দ্বৈত শৈবাগম ভিত্তিক । কিন্তু কুলাচার /কৌলাচার ও ত্রিকাচার হল অদ্বৈতমার্গিক শৈবাচার, যা অদ্বৈত শৈবাগম (ভৈরবাগম) ভিত্তিক। তবে কৌলাচার আর ত্রিকাচারের মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। কৌল শৈবরা জ্ঞান, চর্যা, মেলাপ, ক্রিয়া ও যোগ এই পাঁচটি স্তরকেই সমান গুরুত্ব দিয়েছেন কিন্তু ত্রিকাচারী শৈবরা চর্যা ও মেলাপকে বাহ্যাচার হিসেবে ধরে তা বর্জন করেন এবং জ্ঞান অপেক্ষা যোগাচারকে (যেমন - বিজ্ঞানভৈরব যোগ) বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
মহাসিদ্ধ শৈবযোগী গুরু গোরক্ষনাথ তাই বলে গিয়েছেন -
" কুলাচারবিহীস্তু গুরুরেকোহি দুর্লভ "
(গুরু গোরক্ষ নাথ বিরচিত ' অমনস্ক যোগ ' /২/১৬)
অর্থ - কুল আচার পালনকারী গুরু অনেকেই আছেন, কিন্তু কুলাচার বিহীন (অর্থাৎ কুল আচারের উর্ধ্বে) একজনই গুরু আছেন, তাঁকে পাওয়া দুর্লভ।
এই আত্মজ্ঞান মার্গী শৈব যোগাচারের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন হেতু তিনি আরো বলেছেন -
" যোগমার্গেষু তন্ত্রেষু দীক্ষিতাস্তাংশ্চ দূষকাঃ |
তে হি পাখণ্ডিনঃ প্রোক্তাস্তথা তৈঃ সহবাসিনঃ || ৫ || যোগমার্গাৎপরোমার্গো নাস্তি নাস্তি শ্রুতৌ স্মৃতৌ | শাস্ত্রেষন্যেষু সর্বেষু শিবেন কথিতং পুরা || ২১ || "
(শম্ভুজ্যোতি শ্রীগুরু গোরক্ষ নাথ বিরচিত 'সিদ্ধসিদ্ধান্ত পদ্ধতি/ পঞ্চম উপদেশ)
অর্থ - যোগমার্গ এবং তার উপায়ভূত তন্ত্রমার্গে (যোগাচারী শৈব তন্ত্রোক্ত মার্গ) দীক্ষিত ব্যক্তিদের যারা নিন্দা করে থাকেন এবং সেই নিন্দুকদের যারা সমর্থন করে থাকেন তারা উভয়েই পাখণ্ডী হিসেবে অভিহিত হন। যোগমার্গের থেকে উচ্চতর অপর কোনো মার্গ নেই, ইহাই সর্ব শ্রুতি এবং স্মৃতির সিদ্ধান্ত। পুরাকালে (পরমেশ্বর আদিনাথ) শিব কর্তৃক এই যোগমার্গের জ্ঞান বিভিন্ন শাস্ত্রে (তন্ত্র, আগম, পুরাণ) ও সর্বস্থানে কথিত হয়েছে।
বেদাচার হতে মতাচার পর্যন্ত সমস্ত আচার আসলেই ত্রিক আচারের আণবোপায় ও শাক্তোপায় এর মধ্যেই পড়ে কিন্তু এই দুই আচারের উর্ধ্বে উঠে যোগ ও শক্তিপাতের মাধ্যমে শাভম্ভোবোপায় অবস্থা এবং সর্বোচ্চ অনুপায় অবস্থা/পরাভৈরব-পরমশিব অবস্থা (অহং ব্রহ্মাস্মি) প্রাপ্ত হওয়াই ত্রিক শৈবযোগীদের মূল লক্ষ্য। তাই ত্রিকশৈবাচার সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সমস্ত কিছুর সার। সেই জন্যই ত্রিক শৈবদের মূল শাস্ত্র শিবসূত্রে - আণবোপায়, শাক্তোপায়, শাম্ভবোপায় এই তিন উপায় মার্গিক জ্ঞানই ক্রমান্বয়ে স্তরে স্তরে নিহিত রয়েছে (উপায় তিন- তাই নাম ত্রিক, এটি বুঝতে হবে।)
ত্রিক শৈব মতে কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড উভয়ই প্রাধান্য পায়, শুধু তা সাধকের অন্তঃ সাধন স্তরের উপর নির্ভর করে। সাধক যখন আণবোপায় স্তরে থাকে, তখন তাঁর ক্ষেত্রে কর্ম, হোম, জপ, তপ, আগমোক্ত আচার এসব প্রাধান্য পায়, এইগুলির অস্তিত্ব শাক্তোপায় স্তর পর্যন্ত থাকে। কিন্তু সাধক যখন তীব্র শক্তিপাতের দ্বারা শাম্ভবোপায় অবস্থায় এসে উপনীত হন, তখন তাঁর ক্ষেত্রে বাহ্যিক আচার অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, তিনি অবধূত অবস্থা প্রাপ্ত করেন, তখন তাঁর ক্ষেত্রে অদ্বৈত শৈব আগমমার্গী আত্ম যোগ সাধনা ছাড়া আর কিছুই প্রযোজ্য হয় না এবং তিনি আত্ম জ্ঞানমার্গী হয়ে পড়েন।
তাই সমস্ত প্রকারের শৈব তন্ত্রের, ষড়ান্নায় ক্রমের, চতুঃপিঠ তন্ত্র ক্রমের (মন্ত্র, বিদ্যা, মুদ্রা ও মণ্ডলপিঠ) সার এই ত্রিকশাস্ত্র। এই ত্রিক শাস্ত্রের তিন ভাগ - কর্মমার্গী 'সিদ্ধা' তন্ত্র, জ্ঞামার্গী 'নামক' তন্ত্র এবং উভয়মার্গী 'মালিনীমত' তন্ত্র। সুতরাং, এই তিনের সার-ই হল মালিনী সিদ্ধান্ত, ইহাই সর্বশ্রেষ্ঠ, কারণ এখানে জ্ঞান ও কর্ম উভয়ই প্রাধান্য পায়। ইহাই ক্রম ও প্রত্যভিজ্ঞা মতের শৈব মান্যতা।
" তচ্চ সিদ্ধা-নামক-মালিনাখ্য খণ্ড ত্রযাত্মকত্বাৎ ত্রিবিধম্ |
তত্র ক্রিযাপ্রধানং সিদ্ধাতন্ত্রম, জ্ঞানপ্রধানং নামকং তন্ত্রম্,
তদুভযমযং মালিনীমতম্ ইতি তদেব মুখ্যম্ |...(তথ্যসূত্র - জয়রথ বিবেক ভাষ্য/তন্ত্রালোক/১/১৮/)
এই ত্রিক আচারই যে সর্বশ্রেষ্ঠ তাঁর উল্লেখ ভগবান অভিনবগুপ্ত একাধিক স্থানে একাধিক ভাবে করে গিয়েছেন-
" দশাষ্টাদশবস্বষ্টভিন্নং যচ্ছাসনং বিভোঃ |
তৎসারং ত্রিকশাস্ত্রং হি তৎসারং মালিনীমতম্ || ১৮ || "....( 'শ্রীতন্ত্রালোক'/১ম আহ্নিক)
অর্থ - 10 টি ভেদবাদী শিবাগম, 18 টি ভেদাভেদবাদী রুদ্রাগম এবং 64 টি অভেদবাদী ভৈরবাগম - এই তিন প্রকার আগম-ই শিব শাসনের অর্থাৎ শৈব পরম্পরার (ত্রিক শৈব) অন্তর্ভুক্ত। এই সবকিছুর সার-ই হল ত্রিকশাস্ত্র এবং তার-ও সার হল মালিনী সিদ্ধান্ত।
' পাশবং জ্ঞানমুঞ্ঝিত্বা পতিশাস্ত্রং সমাশ্রযেৎ | '.....(তন্ত্রালোক/৪/২৫৩)
অর্থ - পশু শাস্ত্র তথা পাশব জ্ঞানকে পরিত্যাগ করে পতিশাস্ত্র অর্থাৎ (পশুপতি) শৈব শাস্ত্র এর আশ্রয় গ্রহণ করা উচিৎ |
সুতরাং, এখানেই প্রাচীন আচার্যের মান্যতার নিরিখে ইহা প্রতিষ্ঠিত হয় যে শৈব আচার, শৈব মার্গ ও শৈব শাস্ত্রই সর্বশ্রেষ্ঠ, জ্ঞানমার্গী এবং মোক্ষপ্রদ।
যখন একজন শৈব সাধক তথা যোগী সঠিক কর্ম ও জ্ঞানমার্গের দ্বারা অথবা সরাসরি শিবের শক্তিপাতের দ্বারা জীবনমুক্ত অবস্থা তথা জগদানন্দ অবস্থায় এসে উপনীত হন, তখন তাঁর নিকট এই সমগ্র বিশ্বচরাচর নিজেরই আত্মস্বরূপ (শিব) হিসেবে প্রতিভাত হয় অর্থাৎ জগৎ সমগ্র বিশ্বপ্রপঞ্চ সেই এক পরমশিবাত্মক হিসেবেই উপলব্ধি করে সে, জগৎ - জীব - শিব/পরমাত্মা --- এই তিন তত্ত্ব এক শিবতত্ত্ব হিসেবেই প্রতিভাত হয় তাঁর কাছে, এখানেই উপনিষদক্ত মহাবাক্যের সার্থকতার প্রকৃত সিদ্ধি ঘটে, সাধক অবধূত অবস্থায় এসে উপনীত হন।
একমাত্র সেই অবস্থায় উপনীত শিব যোগী-দের ক্ষেত্রেই কোনো বিধি, নিষেধ, আচার, বিচার, দ্বৈত কর্ম এসব নিষ্প্রয়োজন হয়ে পড়ে, কেননা সাধক সেইসময় সাক্ষাৎ সদাশিবত্ব লাভ করে যান, ইহাই পঞ্চম-আশ্রম অর্থাৎ অতিবর্ণাশ্রম।
যদি শিবের তীব্র - তীব্র শক্তিপাত ঘটে থাকে সাধকের উপরে তবে এই অবস্থায় উপনীত হতে গেলে কোনোরূপ কর্ম, আচার , চিন্তন, মনন, এমন কি কুণ্ডলিনী ভেদ করবার পর্যন্ত প্রয়োজন পড়ে না, সাক্ষাৎ সরাসরি অনুপায় অবস্থা লাভ করেন।
পরাত্রিশিকা বিবরণ এ অথবা তন্ত্রালোকে দ্বৈতবাদী আচার অর্থাৎ বৈদিক - বৈষ্ণব - দ্বৈত শৈব - বাম - দক্ষিণ - কুল - মতাচার - কৌল এই ক্রমের পর অন্তিম আচার হিসেবে ত্রিক আচার-ই (অর্থাৎ আচারহীন অবস্থা/অনুপায়/ প্রত্যভিজ্ঞা) শৈব পরম্পরার সর্বোচ্চ আচার হিসেবে উক্ত হয়েছে। আচার্য জ্ঞানশিব রচিত 'জ্ঞানরত্নাবলী' মতে ইহাই অন্তঃকৌল ভাব অর্থাৎ পূর্ণত অন্তঃ সাধন ভাব।
তাঁদের জন্য আচার নিষ্প্রয়োজন হলেও কোথাও বলা হয়নি যে আচার বর্জিত তাঁদের জন্য। কেননা আচার বর্জিত হলে পরম্পরাগত রীতিনীতি এবং মহিমার কালান্তরে অবক্ষয় ঘটবে এবং তার জায়গায় অনাচার এসে স্থান দখল করবে, যেটা হচ্ছেও আজ। সেই কারণেই বাহ্যিক আচার এর দরকার, তাই আচার্য অভিনব গুপ্তের মতন মহান সাধক ভস্ম ত্রিপুণ্ড্র, রুদ্রাক্ষ, সাদা উত্তরীয় এসব ধারণ করতেন এবং স্বামী লক্ষ্মণ জূ এর মত উচ্চকোটির সাধকও অমৃতেশ্বর ভৈরবরূপি বাণলিঙ্গ স্থাপনা করে তাঁর পুজো করতেন। ইহাই বহিঃশৈব ভাব।
'জ্ঞানরত্নাবলী' মতে একজন প্রকৃত শৈব এর মধ্যে এই তিনভাব থাকা অতি আবশ্যক।
তপভূমি নর্মদায় স্পষ্টভাবেই উক্ত হয়েছে -
" পণ্ডিত ও সাধক জগতে একথা প্রায়শই শোন যায় যে তন্ত্রসাধন বৈদিক সাধনার মতই সুপ্রাচীন এবং সমান অব্যর্থ ফলপ্রদ ও অনুভব সিদ্ধ সাধন-ধারা। 'তন্যতে বিস্তীর্যতে আত্মজ্ঞানম্ ' - অর্থাৎ যে সাধন-ধারা অনুসরণ করে প্রত্যক্ষভাবে 'আত্মজ্ঞান' নিশ্চিতভাবে এই জীবনেই মানুষ লাভ করতে পারে, তারই নাম প্রকৃত তন্ত্র। এই দৃষ্টিতে শৈবাগম-ই প্রকৃত তন্ত্র। প্রাচীন শাস্ত্রে যেখানে যেখানে তন্ত্রের মহিমা কীর্তন করা হয়েছে, যেখানে যেখানে তন্ত্রের সাধন-তন্ত্রের উচ্চ প্রশংসা করা হয়েছে, সেখানে সেখানে 'তন্ত্র' শব্দে এই শৈবাগম সাধনাকেই বুঝতে হবে।
শৈবাগমতন্ত্রের সাধনা অতি উচ্চকোটির সাধনা । বৈদিক সাধনার চেয়ে তা কোন অংশে ছোট বা হেয় নয়। সর্বাংশে বরং শ্রেয়তর। "
বাংলাদেশ এবং আসামে প্রচলিত যে সমস্ত অর্বাচীন তন্ত্রশাস্ত্র এবং তথাকথিত সাধক মহলে যে পঞ্চমকারাদির প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, তা হতে কাশ্মীরী শৈরাগম তন্ত্রের তত্ত্ব ও সাধনা সর্বাংশে পৃথক। বাংলা এবং আসামে কিংবা অন্যত্রও যে তান্ত্রিক এবং তন্ত্রাচার্য কৌল এবং কুলাবধূত, অঘোরী এবং কাপালিক নামক জীবদেরকে দেখা যায়, তাদেরকে ভ্রষ্টাচারী এবং কামাচার্য বলাই সংগত। শৈবাগম বা শাক্তাগম এর প্রকৃত সাধন- তত্ত্ব সম্বন্ধে তাদের বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। শৈবাগমতন্ত্র আর বাংলাদেশ ও আসামে তথাকথিত তান্ত্রিকদের যে সব বীভৎস বাহ্যাচার এবং পঞ্চ 'ম' কারের সাধনা চলে আসছে, তা কখনই এক নয়।
আশাকরি এরপর থেকে নব্য শাক্ত মতালম্বীরা শৈব আচার ও মতকে পশুমার্গী/পশ্বাচারী বলার দুঃসাহস কদাপি দেখাবে না।